top of page

বেঁচে থাকুক 'পয়লা বৈশাখ'

আসলে নববর্ষ বাঙালিদের মধ্যে আগের মতো সেই হালখাতা- দোকান-মিষ্টির আমেজে ধরা না দিলেও এখনও কিন্তু বেশ জম্পেশ করেই বাঙালি মজে থাকে নববর্ষ উদযাপনে। যতই বাংলা ভাষা-র গেল গেল রব উঠুক না কেন, উৎসব প্রিয় বাঙালিকে নতুন বাংলা বছর উদযাপনের ক্ষেত্রে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারেনি। 'বেঙ্গলি নিউ ইয়ার' হিসেবে সে রমরমিয়ে ধরা দিয়েছে নতুন প্রজন্মের মধ্যেও।


গতকালই তার আঁচ পেলাম বাইরে বেরিয়ে। তীব্র দাবদাহে পুড়ছে গোটা বাংলা। তাপপ্রবাহে মানুষের নাজেহাল অবস্থা। প্রায় ৬ মাস আগে থেকে করে রাখা পুজো দিতে যাবার প্ল্যান ভেস্তে যাবার জোগাড় হয়েছিল এই আবহাওয়ার চোখরাঙানিতে। তার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে ঝুলে পড়েছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের রাজ্য পরিদর্শন। ১লা বৈশাখ তিনি নাকি যাবেন দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিতে, তারপর দিল্লি ফিরবেন। মেয়েকে বলেই দিয়েছিলাম, যাবনা রে। অমিত শাহ-র জন্য সাধারণ মানুষের পুজো দিতে দেরি হবে। গরম, তায় অমিত শাহ আমার মায়ের দর্শন বানচাল করেই দিচ্ছিল আর কি। শেষ মুহূর্তের অমিত শাহ-এর দক্ষিনেশ্বর পরিদর্শনের সময়সূচি পরিবর্তন হওয়া মাত্র লাফিয়ে উঠলাম। গরমকে আর থোড়াই কেয়ার? মা নিশ্চয়ই মুখ তুলে চেয়েছেন। তাই চলো ভবতারিণী দর্শনে।


সকাল- সকাল উঠে স্নান সেরে মা- মেয়েতে মিলে বেড়িয়ে পড়লাম দক্ষিণেশ্বরের উদ্দেশ্যে। প্রথমেই খেলাম ঠোক্কর। একটু আরামে যাব বলে এসি ৩১ এ চড়ে বসলাম, অটোয় না চড়ে। বাসে উঠেই গরম অনুভব করলাম। ভাবলাম, একটু পর হয়ত ঠিক হয়ে যাবে। ওমা, কোথায় কী? এ তো দম বন্ধ করা পরিস্থিতি হচ্ছে যত সময় যাচ্ছে! পরে কন্ডাক্টরের থেকে জানা গেল, বাসের এসি খারাপ! রীতিমতো গরম হাওয়ায় যাত্রীদের তখন হাঁসফাঁস অবস্থা। কেউ কেউ তো রেগে গিয়ে বলছেন, ভাড়া দেবনা, ইয়ার্কি হচ্ছে? এই গরমে খারাপ এসি নিয়ে বাস বের করেছে কেন? যুক্তি ফেলে দেবার নয়। টালিগঞ্জ নামতে নামতে শুনলাম, বাসের কর্মীদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে, এই ট্রিপটা হয়ে গেলেই বাসটা সোজা ডিপোয় নিয়ে যেতে হবে এসি ঠিক করার জন্য। ভাবলাম, যাক সুমতি হয়েছে।


তো যাই হোক, ৮.৩০ র মধ্যে পৌঁছে গেলাম মন্দির চত্বরে। জুতো এবং মোবাইল জমা দিয়ে মূল মন্দিরে প্রবেশের পথের লাইন খুঁজতে গিয়ে ভিরমি খাওয়ার জোগাড়! সর্পিল আকারে মন্দির চাতালের এমাথা- ওমাথা তিনটে বাঁক বেঁকে লাইন চলে গেছে গেটের বাইরে। ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে যেতে কিছুক্ষন গেটের কাছে দাঁড়ালাম। এক পুণ্যার্থী বলে উঠলেন, দিদি, বালি ব্রিজ অব্দি লাইন রয়েছে। সক্কাল সক্কাল এত ঝক্কি পুইয়ে এসে এমন দেখলে কেমন মনে হয়, বলুন? কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। পাশে পুলিশ দেখে এগিয়ে গেলাম। বললাম, দাদা, ১ নং গেটের আশপাশে কোনও লাইনের ব্যবস্থা নেই? উনি বললেন, এই একটা লাইন, আর একটা লাইন ওইদিক দিক দিয়ে গেছে। শুনেছিলাম, মার্কেটের ওপাশ দিয়ে একটা লাইন হয়। কিন্তু জানতাম না, ঠিক কোথায় লাইনটা দেওয়া হয়। ওমনি আর একজন লাইন থেকে বলে উঠলেন, বৌদি, সেই তো লাইন গিয়ে মন্দিরের চাতালে ভাগ হবে। তবু চুপ করে থেকে শেষ চেষ্টা করার মত, এগিয়ে গেলাম ১ নং গেট পেরিয়ে পেছনের দিকটাতে। সেখানে তো মন্দির থেকে বেরোনোর রাস্তা। তবু মনে হচ্ছে দূরে যেন একটা লাইন রয়েছে, ধীর গতিতে এগোচ্ছে সেটি। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আর এক পুলিশকে শুধালাম, এদিকে কী মূল মন্দিরে যাবার কোনও লাইন আছে? উনি তৎক্ষনাৎ উত্তর দিলেন, ওই ডালার দোকানগুলোর পাশ দিয়ে চলে যান, পেয়ে যাবেন লাইন। ব্যাস, আমার যেন ধড়ে প্রাণ এলো।


তবু লাইনের পাশ দিয়ে যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। শেষ দেখা যাচ্ছেনা। পরে ভবতারিণী ট্রাস্ট এর প্রাইভেট রাস্তার বাইরের দিকে গিয়ে লাইনের শেষ দেখা গেল। অবশেষে ৮.৫০ মিনিটে লাইন দিলাম পুজো দেওয়ার উদ্দেশ্যে। এত কথা বলার উদ্দেশ্য, ওই যে প্রথমে বলেছিলাম, এখনও নববর্ষ আলাদা মাত্রা রাখে বাঙালির মধ্যে। শুধু বাঙালিই নয়, বহু অবাঙালিকেও দেখলাম কষ্ট করে লাইনে দাঁড়িয়ে পুজো দিতে। মাঝে এই অবাঙালি গোষ্ঠীই লাইন ভাঙার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু একটু বাদানুবাদের পর তা মিটে যায়। পুণ্যার্থী বলতে কিন্তু শুধুই বয়স্ক বা মধ্যবয়সীরা ছিলেন না। রীতিমতো বাচ্চা থেকে সমস্ত বয়সীরা ছিল লাইনে। স্কুল পড়ুয়া- কলেজ পড়ুয়া সকলেই লাইন দিয়ে পুজো দেবার জন্য এসেছিল মায়ের মন্দিরে। এখানে আর একটু বলে রাখা ভালো, অন্যের কষ্টকে গুরুত্ব না দিয়ে যাঁরা নিজেরটুকু নিয়ে ভাবেন, তাঁদের এমন গুরুত্বপূর্ণ দিনে পুজো দিতে না আসাই বাঞ্ছনীয়। পাশাপাশি বয়স্করা এই গরমে, পুজো দিতে নাই বা গেলেন। শরীরকে কষ্ট দিয়ে, অন্যান্য পুণ্যার্থীদের আতঙ্কের মধ্যে না ফেলে সঠিক পরিস্থিতিতে পুজো দেওয়ার মনস্থ করুন। সত্যি বলছি, নিজেরাই যখন মনকে শক্ত করে ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি, তখন, পাশে কেউ অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে, অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে দেখলে আত্মবিশ্বাসে টাল খায়। মনে হয়, আমি আদৌ পারব তো?


অনেকের সঙ্গেই এমন হয়েছে গতকাল। বহু মানুষ অজ্ঞান হয়ে গেছেন। বহু মানুষ একটু পর পরই ভেবেছেন, আর পারছিনা! আবার সাহস সঞ্চয় করে এগিয়েছেন লাইন দিয়ে। অনন্য অভিজ্ঞতা হল কাল। তবে মাঝে হনুমান ব্রিগেড বেশ মনোরঞ্জন করেছে এবং সময় কাটিয়ে দিয়েছে আমাদের। আমরা যে দিকটা দিয়ে এগোচ্ছিলাম, সেদিকটায় গাছপালা এবং দোকানপাটের জন্য বেশ ছায়া ছায়া ছিল, রোদের তাপ থাকলেও তা সহনীয় হয়ে যাচ্ছিল ওই কিছুদুর পর পর ছায়ার আরামে। কিন্তু সামনের দিকের লাইনে সে জো ছিলনা। সেদিকের লাইনে দাঁড়িয়েই বেশি মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তবে পাক্কা দু'ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে অবশেষে ঠিক ১১.০০ টায় পুজো সম্পন্ন হল। মোট পাঁচটা লাইন ছিল মূল মন্দির প্রাঙ্গনে। পুলিশ এবং ভলান্টিয়াররা মিলে বেশ নিপুণভাবে পুরো ব্যাপারটা সামলাচ্ছিলেন। আমাদের লাইনের দিকে একটি সংস্থা খাবার জলের প্যাকেটের ব্যবস্থা রেখেছিলেন। সকলকে দেওয়া হচ্ছিল সেই প্যাকেট। আমাদের সঙ্গে জল থাকলেও তা আমরা নিয়েছিলাম এবং ওই দুঘন্টায় ওই জলের প্যাকেটগুলো যথেষ্ট কাজে দিয়েছিল।


পুজো সম্পন্ন করে গরমে বিধ্বস্ত হয়ে গেলাম হালের শপিং মলে। সেখানেও কিন্তু দেখলাম যথেষ্ট লোকজনের সমাহার। বাড়িতে বসে নেই কেউই। গরমকে তোয়াক্কা না করে পরিবারের সঙ্গে বা প্রিয়জনের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছে একটু সময় কাটাবে বলে। ফুড কোর্টে রীতিমতো ভিড়। কে বলবে বাইরে ৪০/৪১ ডিগ্রী চোখ রাঙাচ্ছে? তবে যাই বলুন, এমনভাবে সবাইকে হুজ্জুতে মেতে উঠতে দেখলে কিন্তু বেশ লাগে। তাই বলব, বেঁচে থাকুক পয়লা বৈশাখ। এই একটি দিনেও অন্তত মনে হবে বাংলা বলে একটি ভাষা আছে। বাঙালি বলে একটি জাতি আছে, যারা তাদের নতুন বছরকে স্বাগত জানাচ্ছে যে কোনও পরিস্থিতিতে।


Top Stories

bottom of page