স্বর্ণালী গোস্বামী
দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়ে অনেক সম্প্রদায়ের জন্য বাওবাব গাছের গভীর সাংস্কৃতিক গুরুত্ব রয়েছে
বেশ কিছুদিন হল রবিবারের আড্ডায় আসা হয়না। বিভিন্ন ব্যস্ততায় বা কখনও আলস্যে এমনটা হয়েছে। তবে কাজের ফাঁকে ইউটিউবে ভিডিও দেখা বা খবরের পোর্টালগুলোতে চোখ বোলানো বন্ধ করিনি। মাঝে একটা বাংলা ওয়েব সিরিজ (কাবেরী, পাওলি দাম অভিনীত) এবং দুটি সিনেমা দেখেছি বাড়িতেই। বেশ কিছু গেট টুগেদার হয়েছে উইক এন্ডগুলোতে। তাই লেখার এবং তার পাশাপাশি নিজস্ব ভিডিও বানানোর কাজে টান পড়েছে। তেমনিই পড়া চালিয়ে যেতে যেতে একটি পোর্টালে দেখলাম আমাদের শৈশবের আশ্চর্য বাওবাব গাছ নিয়ে লেখা। গাছটার নামও ভুলে গিয়েছিলাম। চাঁদের পাহাড়ে পড়া সেই গাছ মনের কোনে দাগ কেটেছিল। সেই সময় তো উইকিপিডিয়া ছিল না, তাই তেমন কিছু জেনে ওঠা হয়নি। সেই আক্ষেপ মিটিয়ে নিলাম সঙ্গে সঙ্গে। আজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এই বিষয়ে যেখানে যত লেখা ছিল, সব পড়ে তার সারমর্ম লিখে ফেললাম। আমার নিজস্ব পোর্টালে নিউজ আপডেট দেওয়া হলনা। সে না হোক, কিছু নতুন বিষয় সম্বন্ধে তো জানলাম।
যেই পড়া শুরু করলাম, ভাবলাম এমনি এমনি শুধু পড়ে রেখে দেবোনা। এবারের রোববার না হয় অন্য কিছু নিয়ে না লিখে এই বিষয়েই বিস্তারিত একটি স্টোরি লিখে ফেলি। অবরে সবরে পড়লে বেশ ভালো লাগবে। প্রথম লেখাটা বেরিয়েছিল, গাছটি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, তাই নিয়ে। কিন্তু পরে জানলাম, সেটা নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই, অনেক বিজ্ঞানীরাই বলছেন, এরা ঠিক নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে যেমন এতদিন রেখেছে। আসুন, সকলে মিলে একটু জেনে নিই গাছটি সম্বন্ধে। এই রোববারে আগে থেকেই লেখা একটি বিষয় নিয়ে বসলাম।
আফ্রিকার আশ্চর্য ‘বাওবাব’ গাছ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দক্ষিণ আফ্রিকার পরিবেশবিদেরা দাবি করেছেন, ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে বাওবাব গাছগুলি। যার নেপথ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। দক্ষিণ আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে বাওবাব গাছের ২০১৮ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে দুই ডজন প্রাচীন এবং বৃহত্তম গাছের বেশিরভাগই মারা গেছে বা গত দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে খারাপ হয়েছে।
আফ্রিকা মানেই যা বিশ্বের পরিচিতি হিসেবে যা জায়গা করে নিয়েছে তা হল বাওবাব। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম হল ‘অ্যাডানসোনিয়া ডিজিটাটা’। এই নিয়ে ২০১৮ সালে ‘নেচার প্ল্যান্টস’ পত্রিকায় একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সেখানেই উঠে আসে বাওবাব মহীরুহের মৃত্যু সংক্রান্ত চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা যায়, ২০১৭ সালের শেষ অবধি, দক্ষিণ আফ্রিকার প্ল্যাটল্যান্ড গাছ, যা সানল্যান্ড নামেও পরিচিত, তাদের রানী ছিল। এটি ছিল মহাদেশের বৃহত্তম বাওবাব, যা প্রায় ১১১ ফুট, ৬২ ফুট উঁচু এবং ১০০০ বছরেরও বেশি পুরানো। এটিতে একটি গুহাযুক্ত কেন্দ্রীয় ফাঁপা জায়গা ছিল যেখানে ১৫ জনের বসার ব্যবস্থা সহ একটি ককটেল বার গড়ে উঠেছিল। ২০১৬ সালের বসন্তের শুরুতে, গাছটি আলাদা হতে শুরু করে। নভেম্বর ২০১৭ এর মধ্যে, এটি সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছিল। বারের মালিকরা ভারী বৃষ্টির কারণে গাছের গোড়া পচে যাওয়াকে দায়ী করেছেন।
আফ্রিকার বাস্তুতন্ত্র নিয়ন্ত্রণে বাওবাব গাছের ভূমিকা অপরিসীম। এই মহীরুহগুলি সেখানকার বাসিন্দা ও প্রাণীকুলকে খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে থাকে। বাওবাব ফল বিক্রি করে আফ্রিকার কৃষকেরা হাজার হাজার টাকা রোজগার করেন। এই ব্যবসা আগামী দিনে এক কোটি ডলারে পৌঁছতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। পুষ্টিবিদদের কথায়, আফ্রিকার এই ফল ভিটামিন সি-তে পরিপূর্ণ। এ ছাড়া এতে পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালশিয়াম এবং অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট রয়েছে। মানবদেহে প্রাকৃতিক প্রোবায়োটিক তৈরিতে সাহায্য করে বাওবাব ফল। অন্ত্রে উপকারী ব্যাক্টেরিয়ার বৃদ্ধিতে এটি সহায়ক বলে জানিয়েছেন তাঁরা। ফলটি অত্যন্ত সুস্বাদুও বটে। আফ্রিকায় তাই বাওবাব গাছের পরিচিতি ‘ট্রি অফ লাইফ’ বা জীবনের গাছ হিসাবে। বাওবাব স্থানীয় উপজাতিদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে রয়েছে। যাঁরা এর পাতা, ফল, বীজ এবং কাণ্ড ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করেন। এটি এমন গাছ যা ২০০০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে বেঁচে থাকতে পারে
তবে দক্ষিণ আফ্রিকার পরিবেশ এবং উদ্ভিদবিদদের একাংশ এই মহীরুহের মৃত্যুর কারণ ঘিরে কিছুটা সন্দিহান। তাঁদের অনুমান, হঠাৎ করে বাওবাবগুলির দেহ রাখার নেপথ্যে রয়েছে সামগ্রিক জলবায়ু বদল। তাঁদের দেওয়া এই তত্ত্ব সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। বিষয়টি উড়িয়ে দিচ্ছেন না অন্য বিজ্ঞানীরাও। অপরদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার পরিবেশবিদদের একাংশ আবার বাওবাব এজ সিম্বল অফ রেজিলেন্স নামের একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। সেখানে আবার দাবি করা হয়েছে, আফ্রিকার মূল ভূখণ্ডে এই মহীরুহের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ‘আফ্রিকান বাওবাব অ্যালায়েন্স’ নামের গবেষণা সংস্থার সদস্যরাও বলছেন, বাওবাবের সংখ্যা যে স্বাস্থ্যকর, সেটা একাধিক সমীক্ষাতেই উঠে এসেছে। যে প্রাচীন গাছগুলি মারা গিয়েছে, তার পিছনে প্রাকৃতিক কারণ রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন বাওবাবকে নিশ্চিহ্ন করছে বলে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। একাধিক গবেষণায় বলা হয়েছে, এই মহীরুহগুলির মৃত্যুর সঙ্গে জলবায়ু বদলের সম্পর্ক থাকার কোনও প্রমাণ নেই। শতাব্দী প্রাচীন সময়কাল ধরে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে তাদের বন্যা, খরা ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। গবেষকেরা জানিয়েছেন, যে বাওবাব গাছগুলি মারা গিয়েছে সেগুলি অত্যাধিক পরিমাণ জল ধারণ করে রেখেছিল। সেটিই মহীরুহগুলির মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়ে অনেক সম্প্রদায়ের জন্য বাওবাব গাছের গভীর সাংস্কৃতিক গুরুত্ব রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার জাম্বেজি নদীর কাছে বসবাসকারী আদিবাসীদের মধ্যে একটি সাধারণ পৌরাণিক কাহিনী রয়েছে যে প্রথম দিকের বাওবাবগুলি তাদের বিশাল আকারের জন্য খুব গর্বিত ছিল তাই শাস্তি হিসাবে দেবতাদের দ্বারা মাটি থেকে ছিঁড়ে ফেলে বাতাসে তাদের শিকড় সহ উল্টোভাবে প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। কেনিয়া ভিত্তিক ওয়ার্ল্ড এগ্রোফরেস্ট্রি সেন্টারের গবেষণা অনুসারে, গ্রামীণ অঞ্চলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য গাছগুলি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গাছগুলি পাখি, টিকটিকি, বানর এবং এমনকি হাতি সহ শত শত প্রাণীর জন্য জল এবং আশ্রয়ের একটি অপরিহার্য উৎস - যা কাছাকাছি জল না থাকলে আর্দ্রতার জন্য তাদের ছাল খেতে পারে৷ এটি ক্রমাগত একাধিক মিশ্রিত ডালপালা বৃদ্ধির কারণেও উল্লেখযোগ্য। এই ডালপালাগুলির মধ্যবর্তী স্থানে ছাল পুনরুত্থিত হয়, যাকে মিথ্যা গহ্বর বলা হয়। এই মহীরুহে বছরে মাত্র ছ’মাস পাতা থাকে। এর ফুলে থাকে পাঁচটি পাপড়ি। ফুলের রং বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যার মধ্যে রয়েছে লাল, হলুদ ও সাদা।
আফ্রিকার মাদাগাস্কারে ‘টি পট বাওবাব’ নামের একটি গাছ রয়েছে। এটির বয়স কয়েক হাজার বছর। অস্ট্রেলিয়াতেও এই গাছ দেখতে পাওয়া যায়। সম্প্রতি এক গবেষণায় পাওয়া গেছে পৃথিবীতে মোট আটটি প্রজাতির বাওবাব রয়েছে। তার মধ্যে পূর্ব আফ্রিকার মাদাগাস্কারেই ছয়টি প্রজাতি পাওয়া যায়; একটি আফ্রিকা মহাদেশে পাওয়া যায়; এবং অপর একটি পাওয়া যায় অস্ট্রেলিয়ায়। এর মধ্যে ‘মালাগাছি’ নামে দুটি প্রজাতির বাওবাব গাছ আছে, যেগুলো মাদাগাস্কারের সবচেয়ে বড় ও বিখ্যাত গাছের তকমা পেয়েছে। মালাগাছিতে বাওবাবের জনপ্রিয় তিনটি নাম রয়েছে। এগুলো হল- ‘মাদার অব ফরেস্ট’ (বনের মা), আপসাইড ডাউন ট্রি (মাথা উল্টো গাছ) এবং ‘ট্রি অব লাইফ’ (জীবন বৃক্ষ)। ডিএনএ পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, চার কোটি ১০ লাখ বছর আগে এই গাছ মাদাগাস্কারের মাটিতে প্রথম মাথা তুলে দাঁড়ায়। বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানায়, মাদাগাস্কার থেকে বাওবাবের বীজ সমুদ্রের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে অস্ট্রেলিয়া এবং আফ্রিকার মূল ভূখণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই একটি স্বতন্ত্র জাতের গাছ বিকশিত হয়। এ গাছ নিয়ে গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন লন্ডনের রয়্যাল বোটানিক গার্ডেন্সের ড. ইলিয়া লেইচ। সঙ্গে ছিলেন তার স্বামী লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অ্যান্ডু লেইচ।
তো এই হল গিয়ে গাছটি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য। আসলে কি জানেন তো, যত পড়ছিলাম, মনে হচ্ছিল, আহা যদি একবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারতাম! গাছটির ফল খেতে পারতাম! ফুল দেখতে পারাতাম নিজের চোখে! গাছের কোটরে হাত ঢুকিয়ে অনুভব করতে পারতাম এর অনন্য সৃষ্টির মহিমা! তাহলে জীবন ধন্য হয়ে যেত।