top of page

'দ্য কেরালা স্টোরি'- একটি সিনেমা এবং কয়েকটি কথা

স্বর্ণালী গোস্বামী

আমার মনে হয়, একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকে বাচ্চাদের মননশীলতা পরিপুষ্ট করার পাঠ থাকা উচিত

এই মুহূর্তে সবচেয়ে হট টপিক বলতেই হয় সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ফিল্ম 'দ্য কেরালা স্টোরি'। তার বিষয়বস্তুই বলুন বা গল্প পরিবেশনের ভঙ্গি। নির্মাতাদের তরফে বলে হয়েছে সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হয়েছে এই ছবি, সেক্ষেত্রে তাঁরা বিষয়বস্তুর ভয়াবহতা যতটা সম্ভব বাস্তবসম্মতভাবে ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছেন। তাই নিয়েই যত গোল। দেশের সেন্সর বোর্ডে ছবিটি পাশ হয়ে গেলেও রাজ্যে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল ছবিটি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে। তবে নির্মাতারা এর বিরুদ্ধে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছিলেন। তাতে সুপ্রিম কোর্ট সেই আবেদনের ভিত্তিতে স্থগিতাদেশ দিয়েছে।

টিজার মুক্তির সময় থেকেই বিতর্ক সঙ্গী হয়ে গেছে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ র। কেরলের হিন্দু মহিলাদের ধর্মান্তরিত করে জোর করে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে কী ভাবে যুক্ত করা হয়েছে তা নিয়েই আবর্তিত হয়েছে বাঙালি পরিচালকের তৈরি এই ছবির গল্প। দেখানো হয়েছে কী ভাবে কেরালার হিন্দু মহিলাদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয় এবং তারপর ইরাক ও সিরিয়ার জঙ্গি ক্যাম্পে তাঁদের পাচার করে দেওয়া হয়। এই ছবির টিজারে দাবি করা হয়েছিল ৩২ হাজার মহিলাকে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। ধর্মান্তকরণের জেরে নির্যাতিতা মহিলা এবং তাঁদের পরিবারের লোকেদের সঙ্গে কথা বলে এই ছবি তৈরি করা হয়েছে এমনই বলেছিলেন নির্মাতারা। কিন্তু বিতর্কের ফলে ৩২ হাজার মহিলার ধর্মান্তকরণের দাবি সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল টিজার থেকে। আসলে সিনেমায় এ রকম তিনজনকেই দেখা গিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হয়ে সওয়ালের সময় এ কথা তুলেছিলেন আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি। পশ্চিমবঙ্গে নিষেধাজ্ঞায় স্থগিতাদেশের পাশাপাশি ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ ছবির প্রদর্শনীর শুরুতে ডিসক্লেইমার বা সতর্কীকরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। বৃহস্পতিবারের শুনানিতে ছবি নির্মাতাদের আইনজীবী হরিশ সালভে স্বীকার করে নিয়েছেন, ৩২ হাজার সংখ্যার পিছনে কোনও তথ্য নেই। আদালতের এই নির্দেশের পর ‘সত্য ঘটনা’ বদলে গেল ‘কাহিনি নির্ভর’ ছবিতে।

এই ব্যাপার থেকে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তাহলে ৩২ হাজারের সংখ্যাটা দেওয়া হল কেন? আমার কাছে যদি যথাযথ তথ্য না থাকে, তাহলে এমন স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে আমি নিশ্চিত সংখ্যা দেখাব কেন? এই ব্যাপারে নির্মাতাদের তরফে আরও একটু সতর্ক থাকা উচিত ছিল বলেই মনে হয়। আর আমার একান্তই ব্যক্তিগত মতামত, ছবির বিষয় যেহেতু যথেষ্ট স্পর্শকাতর, সেখানে শৈল্পিক দিকটাতে একটু বেশি নজর দিলে মানুষের ভাবাবেগে আঘাত হতনা। যদিও একবিংশ শতকে আমরা বহু নৃশংস ব্যাপার হজম করতে শিখে গেছি মিডিয়ার দৌলতে, সেখানে শুধুমাত্র একটি সিনেমা কেন কাঠগড়ায় দাঁড়াবে? তাও ওই যে, কথা হচ্ছে সিনেমা নিয়ে, খবর নিয়ে নয়, তাই। তো যাই হোক, ছবিটি দেখছেন সকলে, তা বক্স অফিস কালেকশনই বলে দিচ্ছে।

তবে প্রধান বিচারপতি জানিয়েছেন, ছবিটি তিনি নিজে দেখবেন।

এইবারে একটি হাড়হিম করা খবর দেখে নিই আসুন।

৫ মে সিলভার স্ক্রিনে মুক্তি পেয়েছে সুদীপ্ত সেন পরিচালিত বিতর্কিত ছবি দ্য কেরালা স্টোরি। ছবির প্রতিপাদ্য হল হিন্দু ও খ্রিস্টান মেয়েদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা হচ্ছে। এই কাহিনি নিয়ে বিতর্ক, বাদানুবাদের মধ্যেই ১৯ মে একটি অনুষ্ঠানে কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা মহিলাদের হাতে ‘কাটারস’ তুলে দিল। যাতে লাভ জিহাদের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা হলে হিন্দু মহিলারা আক্রমণকারীদের অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে আত্মরক্ষা করতে পারেন।

গুজরাতিতে চাকুকে বলা হয় কাটারস। ঘটনাটিও গুজরাতের। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজ্যের কচ্ছ জেলার এই ঘটনা সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে কচ্ছ কাড়ভা পতিদার সমাজ মহিলাদের জন্য তিনদিনের প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করেছিল। তাতে যোগ দেন জেলার ৭০০ মহিলা। তাদের শেখানো হয় জোর করে ধর্মান্তকরণ, প্রেমের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা হলে কীভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। প্রশিক্ষণ শেষে ইচ্ছুক ৫৩০ জনের হাতে কাটারস তুলে দেয় উদ্যোক্তারা। বলা হয় আত্মরক্ষার জন্যই এই আয়োজন।

যদিও ভারতীয় ফৌজদারী দণ্ডবিধি অনুযায়ী এই ধরনের অস্ত্র সঙ্গে রাখা দণ্ডনীয় অপরাধ। একমাত্র শিখ ধর্মাবলম্বীদের শর্ত সাপেক্ষে সঙ্গে ছোট্ট কৃপাণ রাখার অনুমতি আছে। ঘৃণা এবং হিংসা ছড়ানোর ঘটনা জানা মাত্র ব্যবস্থা নিতে হবে, অভিযোগের অপেক্ষায় থাকা চলবে না বলে দিন দশ আগেই সুপ্রিম কোর্ট সব রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলকে সতর্ক করেছে। তাহলে? ছবিটি কিন্তু বিজেপি শাসিত রাজ্যে বেশ রমরমিয়ে চলছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীর রাজ্যে এই ঘটনা কেন ঘটানো হল? অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিজেপির প্রতিনিধিরা। এদিকে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা জানাচ্ছেন এ ব্যাপারে তাঁরা কিছুই জানেন না। তাহলে এই যে একটি দলের বিশেষ করে যে দল কেন্দ্রের সরকার চালাচ্ছে, তাদের উপস্থিতিতে বেআইনি কাজ করা হচ্ছে, তার দায় কার? সরকার নেবে এর দায়? পুলিশ তো ইতিমধ্যেই দায় ঝেড়ে ফেলেছে। গণতান্ত্রিক দেশে কেন হবে এসব? যদি ছবির নির্মাতাদের বিপক্ষে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা বলেন, ছবির জন্য এই সমস্ত বেআইনি কাজকর্ম চলছে। তাহলে? ভুল কে? ছবির নির্মাতারা, না কেন্দ্রের সরকার, না পুলিশ প্রশাসন, না ছবির বিপক্ষের লোকজন? কাকে দোষ দেওয়া যাবে এই ঘটনায়? কিন্তু ঘটনাটা তো ঘটেছে।

আসলে বর্তমানে আমাদের ভাবনার যে প্রকোষ্ঠ আছে, তা একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আমরা বড্ড বেশি হুজুগে চলাটাকেই বুদ্ধিমানের কাজ, অতি আধুনিকতা বলে মনে করি। আগে শুধু শহুরে শিক্ষিতরাই নয়, গ্রামীণ এলাকাতেও বাড়ির শিক্ষা একটা বিশাল জায়গা জুড়ে ছিল মানুষের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে। আস্তে আস্তে রাজনীতি, বিশ্বায়ন, ইন্টারনেট আমাদের নৈতিক বোধগুলো একেবারে বেমালুম ডিলিট করে দিয়েছে। ভোগ সর্বস্ব, হুজুগে, মারকুটে, ভোঁতা, দলাদলি, স্বার্থপরতা আমাদের গ্রাস করছে। এর ভবিষ্যৎ কী? জানা নেই কারও। আসলে শুরু করেছিলাম শুধুমাত্র একটি ফিল্মের কথা দিয়ে। তবে এটা তো ঠিক, ফিল্ম একটা দোহাই মাত্র। নিজেরা ঠিক থাকলে সমাজের সমস্যাই থাকত না। আর তা যদি না থাকত, তাহলে এমন ফিল্মও তৈরি হতনা, আর তার ভয়াবহতাকে ভয় পেয়ে বা সমাজের শান্তি বজায় রাখার জন্য ছবি দেখানোতেও নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হতনা।

আমার মনে হয়, একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকে বাচ্চাদের মননশীলতা পরিপুষ্ট করার পাঠ থাকা উচিত। মুখস্ত করে উগরে দেওয়ার চেয়ে পড়ুয়াদের ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের সেই মতো মেধার পরীক্ষা নেওয়া উচিত। তাতে কেউ দশে এক পেলেও তাকে উৎসাহ দিয়ে এগোতে দিতে হবে। খারাপ মেধার পড়ুয়া বলে হেলা করা যাবেনা, এই শিক্ষা দেওয়া হোক শিক্ষকদের। রাজনৈতিক দলগুলোর ভাবা উচিত চাকচিক্য দিয়ে শহর ঝলমলে করার চেয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক দিশা দেখানো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।


bottom of page