top of page

হিংসায় পুড়ছে ফ্রান্স

স্বর্ণালী গোস্বামী

হিংসায় পুড়ছে ফ্রান্স - দোষই বা কার, সঠিক পথই বা কী, তার বিচার করবে কে?

একটি শিশু যখন জন্মায়, তখন তার দায়িত্ব কেবলমাত্র তার বাড়ির লোকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনা। শিশুটির বার্থ সার্টিফিকেট বলে দেয় সে, সেই দিন থেকে একটি অঞ্চল, তথা জায়গা, তথা রাজ্য, তথা দেশের একজন নাগরিক। জন্মেই মোটেই কেউ প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে যায়না, কিন্তু তার দায়ভার তো রাজ্য বা দেশের ওপর বর্তায়। তাছাড়া যে কোনও দেশে বাইরের দেশ থেকে যদি বেআইনিভাবে কেউ অনুপ্রবেশ না করে, তাহলে সেই মানুষটির জীবন রক্ষার দায়িত্বও উক্ত দেশ অস্বীকার করতে পারেনা।

তবে নাহেল কিন্তু ফ্রান্সেই বড় হয়েছিল। প্যারিসের নানতেরে শহরেই বেড়ে উঠেছিল ১৭ বছর বয়সী নাহেল এম। সে খাবার ডেলিভারির কাজ করত এবং রাগবি লিগে খেলত। মায়ের একমাত্র সন্তান। নাহেলের বাবার সম্পর্কে তেমন কোনও আলোচনা হচ্ছেনা। ধরে নেওয়াই যায় বাড়িতে বাবার অভাব ছিল। নাহেলের মায়ের একমাত্র সম্বল ছিল তার ছেলে। এবার বলুন তো, সেই ছেলেকে দেশের পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলে দেশের কী এমন মহৎ কার্য সম্পন্ন করতে চেয়েছিল?

হ্যাঁ। নাহেলের দোষ ছিল। ১৭ বছরের একটি টগবগে ছেলে রাস্তার আইন অমান্য করেছিল। তাই বলে গুলি করা হবে তাকে? সেই পুলিশকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। কিন্তু তাতে কী সেই প্রাণ ফিরে আসবে? দেশের আইনে পুলিশদের এত ক্ষমতা দেওয়া হবে কেন? ট্রাফিক আইন অমান্য করলে পুলিশের গুলি করে মেরে ফেলার ক্ষমতা থাকবে কেন? সেই পুলিশকেও তার ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষ যদি তৎক্ষণাৎ গুলি করত, তাহলে বলুন তো, ফ্রান্স কী এভাবে আগুনের গ্রাসে যেত? ফ্রান্সের সরকার দেশের সংখ্যালঘু জনগণকে কথা দিতে পারবেন, ওই ঘাতক পুলিশের মৃত্যুসাজা দেওয়া হবে? ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এই উত্তেজনার মধ্যে কী করছেন? তিনি এলটন জনের আমন্ত্রণে পার্টি করছেন। এই আচরণ কী সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলে?

নাহেল কিন্তু তার দুর্বল দিকগুলোর খামতি পূরণ করতে সচেষ্ট ছিল। স্কুলে খুব ভালো পড়াশোনায় ছিলনা বলে ‘ওভাল সিটিয়েন’ নামের একটি সমিতির কর্মসূচিতে অংশ নিত নাহেল। স্কুলে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে এমন কিশোর-কিশোরীদের জন্য একটি কর্মসূচি পরিচালনা করে ‘ওভাল সিটিয়েন’ নামের একটি সমিতি। ওভাল সিটিয়েনের এই কর্মসূচির লক্ষ্য হলো, সুবিধাবঞ্চিত এলাকার মানুষকে শিক্ষানবিশ হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া। নাহেল সেখানে ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ শিখছিল। নাহেল গত তিন বছর পাইরেটস অব নানতেরে রাগবি ক্লাবে খেলেছে। যারা নাহেলকে চেনেন, তাদের ভাষ্য অনুযায়ী নাহেল ভালো ছেলে ছিল এবং সবাই তাকে ভালোবাসতো। তার মা এবং দিদা তো স্বাভাবিকভাবেই শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন। আচ্ছা, যেই পুলিশকর্মীটি তাকে খুন করল, সে কি নাহেল সম্পর্কে এত তথ্য জানত? কী মনে হয়, এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যাকে আমি মৃত্যুসাজা পাওয়া উচিত বলে দেগে দিচ্ছি, সেই মানুষটা সম্পর্কে আমার জানাটা পুলিশ হিসেবে আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়েনা? যদি না পড়ে, তাহলে আমি প্রশ্ন তুলব, কেন পড়েনা? দেশের আইনে এইভাবে বিশ্লেষণ করা নেই কেন? দোষ করলে দোষীর ঠিক কতখানি সাজা পাওয়া উচিত, তা তার মানসিক, চারিত্রিক, স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবেনা কেন?

সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, একজন পুলিশ অফিসার একটি গাড়ির চালকের দিকে বন্দুক তাক করে আছে। এর পর একটি গুলির শব্দ শোনা যায় এবং তারপর গাড়িটি থেমে যায়। নাহেলের মৃত্যু ফ্রান্সে বর্ণবাদ এবং সংখ্যালঘু জাতি-গোষ্ঠীর মানুষদের প্রতি পুলিশের বৈষম্যমূলক আচরণের ব্যাপারে ক্ষোভ উস্কে দিয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পুরো ফ্রান্স সহিংস বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে। ঘটনার প্রতিবাদে মঙ্গলবার রাত থেকেই প্যারিস ও অন্য আরো কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ ও সহিংসতা শুরু হয়। লাগাতার বৈষম্যের কারণে গরিব, ভিন্ন বর্ণের মানুষের মধ্যে ক্রমশ যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল, তা মঙ্গলবারের ঘটনার পর আগ্নেয়গিরির ফুটন্ত লাভার মতো বেরিয়ে আসতে থাকে। ফ্রান্সের বিভিন্ন শহর এবং শহরতলি এলাকায় হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। প্যারিসের তুলনামূলক নিম্নবিত্ত এলাকা, মার্সেই, লিয়ঁ, তুলুস, লিলির মতো জায়গায় লাগামছাড়া হিংসা ছড়িয়েছে। পোড়ানো হয়েছে অসংখ্য গাড়ি। লিয়ঁ ট্রামে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। উত্তর প্যারিসে একটি ডিপোয় ১২টি বাস পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে।

ফ্রান্সের একাধিক বড় শহরে গণপরিবহণ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। প্যারিসে প্রতিদিন রাত ন'টার পর থেকে বাস এবং ট্রাম পরিষেবা বন্ধ হয়ে যাবে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সরকারি তরফে। আবার ফ্রান্সের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মার্সেইতে সন্ধ্যা সাতটার পর গণপরিবহণ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রশানের তরফে জানানো হয়েছিল ওইদিন, রাতভর ৮৭৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২০০-র বেশি পুলিশ আহত হয়েছেন। ৪০,০০০-র বেশি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

এতেই কিন্তু থামানো যায়নি বিক্ষোভকারীদের। বৃহস্পতিবার মার্সেইয়ের আলকাজার গ্রন্থাগারে হামলা চালায় বিক্ষোভকারীরা। ভেঙে দেওয়া হয় লাইব্রেরির জানালা। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় প্রবেশপথেও। যদিও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, হামলাকারীরা গ্রন্থাগারটিকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে পারেনি। অল্পের জন্য বড় কোনও ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে গ্রন্থাগারটি। এমনকি ব্যাঙ্ক লুটের ঘটনাও ঘটছে। এদিকে, বিক্ষোভ থামাতে এখনও পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মৃত্যু হয়েছে এক বিক্ষোভকারীর। আহত প্রায় ২০০ জন পুলিশকর্মীও। এরই মাঝে অভিযুক্ত পুলিশকর্মী নিহতের পরিবারের কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন। কিন্তু তাতেও বিক্ষোভ কমার কোনও লক্ষণ নেই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জরুরি বৈঠকও ডেকেছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। ইতিমধ্যেই ৪৫ হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।

এর মধ্যেই আবার যোগী আদিত্যনাথের ‘মডেল’ অনুসরণ করেই হিংসা থামানো যেতে পারে ফ্রান্সে! শুক্রবার থেকেই সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল প্রচার। শনিবার তাতে সায় দিয়েছে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর দফতরও!

বলুন তো, এটাও কী কাম্য ছিল? বিক্ষোভকারীরা এমন মাতালের মত, পাগলের মত ধ্বংসলীলাতেই বা মেতে উঠবে কেন? কেন সীমা থাকবেনা বিদ্রোহের? কেন একটা প্রাণের জন্য দেশের আপামর মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতে হবে? বিদ্রোহের মধ্যেও, বিক্ষোভের মধ্যেও থাকা উচিত সহনশীলতার পরিচয়। তবেই সেটা সঠিক বিক্ষোভ হয়ে উঠতে পারে। সরকারি জিনিস ধ্বংসই যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে বিক্ষোভ প্রদর্শনের, তাহলে তার মধ্যেও সীমা থাকা উচিত।

ভিক্টর হুগো, বোঁদলেয়ার, ভের্লেনর কলমের দেশ ফ্রান্স। রেনোয়াঁর তুলির দেশ। সেই কবিতার দেশে, ছবির দেশে এখন জ্বলছে আগুন। আন্দোলনকারীরা একবারও ভাবলনা, মূল্যবান বইগুলি পুড়িয়ে ফেলে শুধু ফ্রান্স নয়, সারা বিশ্বের বইপ্রেমীদের নজরে কতখানি ভিক্টিম হয়ে রইল তারা। এ কলঙ্ক কোনোদিনও মুছবেনা। ইতিমধ্যেই নিন্দায় সরব হয়েছেন নেটিজেনরা। একজন টুইটে বলেছেন, ” আমরা বই পোড়াচ্ছি না। নিজেদের গায়েই আগুন দিচ্ছি।”

এদিকে এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সেদেশের প্রেসিডেন্ট কী বলছেন? এই আবহে এই অশান্ত পরিবেশের জন্য টিকটক, স্ন্যাপচ্যাটের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মকে দায়ী করছেন সেদেশের রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। তাঁর অভিযোগ, সোশ্যাল মিডিয়ার কারণেই হিংসা ছড়িয়েছে দেশের বহু প্রান্তে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এক জায়গার হিংসা দেখে তার অনুকরণেই অন্যত্র হিংসা ছড়াচ্ছে বলে অভিযোগ ম্যাক্রোঁর। এখনও পর্যন্ত এই হিংসার জেরে ৪৯২টি সরকারি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে ম্যাক্রোঁ প্রশাসন। বিভিন্ন জায়গায় নতুন করে ৪৫ হাজার পুলিশ এবং আধাসেনা নামিয়েছে ফরাসি সরকার। ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমানিন বলেন, "যেই দোষী হোক না কেন, তাদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।" আশা করব সেই ব্যবস্থা আর যাই হোক না কেন মৃত্যুদন্ড হবেনা।

একটি ভিডিও ঘিরে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। এই ভিডিওয় গায়ক এলটন জনের কনসার্টে স্ত্রী ব্রিজেটের সঙ্গে ম্যাক্রোঁকে দেখা গিয়েছে। বলা হচ্ছে, দেশ হিংসার আগুনে পুড়ছে আর প্রেসিডেন্ট এলটন জনের কনসার্টে নাচছেন।

গত বৃহস্পতিবার চিনা পর্যটক বোঝাই বাসে হামলা চালিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। সেই সময়ে আহত হন বাসে থাকা চিনা পর্যটকরা। তারপরেই রবিবার একটি বিবৃতি জারি করা হয়েছে চিনের দূতাবাসের তরফে। মার্সেইয়ের দূতাবাস থেকে স্পষ্ট জানানো হয়েছে, চিনা পর্যটকদের জীবন ও তাঁদের সম্পত্তির নিরাপত্তা দিতে হবে ফ্রান্সের প্রশাসনকে।

এইভাবে চলতে থাকলে কার লাভ হচ্ছে? প্রশ্ন সেখানেই ওঠে। মাঝখান থেকে এক পুলিশ একটি তরতাজা প্রাণ কেড়ে নিল। সাধারণ মানুষ মত্ত হয়ে গোটা অঞ্চলে ধ্বংসলীলা চালাল, সরকার কখনও আলোচনা করলেন, সেনা নামালেন, গ্রেফতার হল প্রচুর বিক্ষোভকারী, সোশ্যাল মাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন দেখা গেল, পর্যটকরা ঘুরতে এসে বিপদে পড়লেন, যত্নে রাখা লাইব্রেরি পুড়ে ছারখার হল, ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিন্তু দোষ যে কার, অথবা কে যে ঠিক, তার হিসেবে হবে কীভাবে?

প্রতিদিনের খবর এবং বিভিন্ন ফিচার ভিত্তিক লেখা, যেখানে খবরের সত্যতা তথা লেখনীর উৎকৃষ্টতা প্রাধান্য পায়। ফিচার ছাড়াও যে কোনও রকম লেখনী শুধুমাত্র উৎকৃষ্টতার নিরিখে গুরুত্ব পাবে এই সাইটে

Thanks for subscribing!

  • Whatsapp
  • Youtube
  • Instagram
  • Facebook
  • Twitter

The Conveyor

bottom of page