top of page

সিনেমা- বাস্তবের মিশেলে মন যখন ফুরফুরে করে রাখার চেষ্টা

স্বর্ণালী গোস্বামী

আমাদের প্রশ্ন জাগেনা? সাধারণ, বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষ বুঁদ হয়ে থাকে ধর্ম নিয়ে

Zee 5 এ Mrs. দেখলাম। আসলে এত তাড়াতাড়ি খুব একটা সিনেমা দেখা হয়ে ওঠেনা। ক'দিন আগেই ওটিটি তে সিনেমাটি রিলিজ করেছে। তার মধ্যেই শুক্রবার দিন দেখে ফেললাম। মেয়েকে নিয়েই বসেছিলাম দেখতে। ফেসবুকে তিন/চার জনের রিভিউ পড়লাম, স্ক্রলিং করতে গিয়ে। বুঝলাম, বিষয়টা অসাধারন, এবং পরিচালকের মুন্সিয়ানায় সিনেমাটিও অতীব প্রসংশা তথা সমালোচনা কুড়োচ্ছে। কাজেই দেরি না করে দেখে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তো, গোটা সিনেমাটা টানটান বলাই বাহুল্য। সংসারের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে একটি মেয়ের (বলা ভালো বিয়ে হয়ে আসা নতুন বউ- এর) দেওয়ালে পিঠ থেকে যাওয়ার পর প্রতিবাদে গর্জে উঠে ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনী।

বেশ কিছু সপ্তাহ রোববারের আড্ডায় আসা হয়নি। শুরুতে শুরুতে প্রতি সপ্তাহেই লিখতাম। তবে যা হয়, কখনও সময়ের অভাব তো কখনও আলসেমি, বাদ পড়ে যায় মাঝে মাঝেই। ভাবছিলাম কি বিষয় নিয়ে লিখব। পাশের রাষ্ট্র বাংলাদেশেই এখন রোজের খবর, প্রধানমন্ত্রী ঘুরে এলেন, ফ্রান্স, আমেরিকা থেকে, আমাদের দেশে মহাকুম্ভ। বিষয়টা কি রাখা যায়। ভাবনার মধ্যেই এই সিনেমা দেখা। তাই ভাবলাম, এই একেবারে ঘরের চারদেওয়াল এবং ঝাঁ চকচকে দুই দেশের প্রধানের করমর্দন মিলিয়ে দিলে বেশ হয়। তাই সেই রকমই কিছু একটা লেখার মন নিয়ে বসে পড়লাম। তো শুরু করছি সংসারের এই আখ্যান দিয়ে।

মিসেস নিয়ে অনেকে অনেক কথাই বলছেন। একটাও অযৌক্তিক নয়। তার মধ্যে দেখলাম পুরুষকেন্দ্রিক একটি মানবতাবাদী সংস্থা খেপে উঠেছে নারীকেন্দ্রিক মতামত শুনে। যথারীতি সমাজমাধ্যমে মারপিট শুরু হয়ে গেছে দুই দলের মধ্যে। একদল বলছে, সংসারে পুরুষদের সমান ভাগে কাজ করা উচিত, অন্য দল বলছে, পুরুষরা যে বাইরে পরিশ্রম করে, তারা আবার ঘরে পরিশ্রম করবে কেন? এবার আসি আমার মতামত নিয়ে। ছবিতে অসাধারন ক্যামেরা গল্পটিকে আমাদের কাছে আরও গভীরে প্রবেশ করাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কোনও কোনও জায়গায় অসাধারন এডিটিং। অভিনয়ও যথেষ্ট ভালো প্রধান চরিত্র রুচি- র। সিনেমাটি একটি মননে নাচ নিয়ে বাঁচা এক তরুণীর নতুন বিয়ের পর ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাওয়ার গল্প। এখানে রান্নাঘর এবং একান্ত নিজস্ব পরিসরের খুঁটিনাটি বিষয় তুলে ধরেছেন লেখক এবং পরিচালক। সমস্যা একজন নারীর রান্নাঘরে সারা দিন কাটিয়ে দেওয়া নিয়ে নয়। সমস্যা জবরদস্তি কোনও মেয়েকে রান্নাঘরে কাটানোতে বাধ্য করার। আমরা দেখছি, রুচির শাশুড়ি ইকনমিক্সে ডক্টরেট করা সত্ত্বেও অবলীলায় বরের সকালে ইসবগুল গুলে মুখের সামনে ধরা থেকে জুতো বের করে রাখা থেকে রান্নাঘর সামলানো। কিন্তু আজকের দিনের রুচির সেগুলো দেখে দম বন্ধ হয়ে আসছে। সমস্যা তৈরি হচ্ছে এখান থেকেই। একজন হাসি মুখে যা সামলাচ্ছে, পৃথিবীর সকলকে তা হাসিমুখেই সামলাতে হবে তা তো হওয়া উচিত নয়।

সমস্যা বাড়ির পুরুষ মানুষকে সংসারের কাজ করা নিয়ে নয়, সমস্যা বাড়ির পুরুষদের নিজের কাজটুকু নিজে না করা নিয়ে। জল হাতের কাছে এনে দেওয়া (সবসময়), জুতো, জুতোর তাক থেকে বের করে দরজার সামনে রাখা (সবসময়), স্নানের আগে জামাকাপড় বের করে গুছিয়ে রাখা (সবসময়), বাড়িতে কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও রাতে সমস্ত এঁটো বাসন পরিষ্কার করে রান্নাঘর মুছে রাখা (প্রতিদিন, নইলে বাড়ির বাস্তু দোষ হয়)- ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। তার ওপর সমস্যা নাচকে প্রফেশন করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে বাড়িশুদ্ধ সকলের তাচ্ছিল্যের পাত্রী হওয়া। রান্না ঘরে অনবরত পাইপ দিয়ে জল লিক করা সত্ত্বেও স্বামীকে প্লাম্বার আনতে বলা হলেও দিনের পর দিন তা এড়িয়ে যাওয়া, বাড়ির সব কাজ সামলে নিজে পার্ট টাইম কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তা জোর করে করতে না দেওয়া। প্রতি মুহূর্তে নতুন মেয়েটি কাজে কতটা অপারদর্শী তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া ইত্যাদি এবং ইত্যাদি।

আজকের সমাজে দাঁড়িয়ে একজন পুরুষ, বিশেষ করে ডাক্তার, বা আইটি সেক্টরে কাজ করা কোনও ইঞ্জিনিয়ার বা কর্পোরেট জগতের যে কোনও পদাধিকারী ব্যক্তির যথেষ্ট কাজের চাপ থাকে তা স্বাভাবিক। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, যদি কোনও নারী সেই যোগ্যতা অনুযায়ী কোনও চাকরি না করে, তাহলে তার স্বামীকে বাড়ির কাজে হাত লাগাতে বলা অনুচিত। কিন্তু সেখানেও ব্যাপার আছে। বাড়ির বউ নিশ্চয়ই বাড়ির কর্মচারী নয়। আজকাল বাড়ির কাজ কর্ম সামলানো হাউসওয়াইফদের হোমমেকার বলা হয়। তার নিজের মত করে সে সংসার চালাবে, তার প্রয়োজনে একজন বা দুজন সাহায্য করার লোক থাকবে। তারা তাদের কাজ করবে, সেই সমস্ত কাজ সুপারভাইজ করবে বাড়ির যে স্ত্রী সে। কিন্তু বাড়ির পুরুষ মানুষেরা যদি সারাক্ষন কাজের লোকের মত প্রতি কাজে খুঁত ধরে, প্রতি মুহূর্তে নিজের ফরমায়েশ খাটাতে বাধ্য করে, প্রতি রাতে সঙ্গম করতে বাধ্য করে, স্ত্রী হাজার ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও, তাহলে প্রশ্ন উঠবে বৈ কি। নিজে হাজারবার বৌকে অসম্মানজনক কথা বলে 'জোকস আ পার্ট' বলবে, বৌ কখনও সত্যি কথাটা মজার ছলে বন্ধুর সামনে বললে পরিস্থিতি গম্ভীর করে দিয়ে, নিজের স্টেটাসের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাকে জোর করে 'সরি' বিলিয়ে নেবে, তখন প্রশ্ন উঠবে বৈ কি। নিজের কাজের যথেষ্ট গুরুত্ব, কিন্তু বউ তেমন রোজগার করার মত কোনও কাজ করতে পারবেনা বলে, সেই কাজের কোনও গুরুত্ব নেই তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে প্রশ্ন উঠবে বৈ কি।

এই ছবিতে সেখানেই গর্জে উঠেছে প্রধান চরিত্র। আহা পাইপের জমা জল অতিথিদের হুকুমের শিকনজি হিসেবে গ্লাসে ঢেলে দিয়ে আসার যে দৃশ্য, তা দেখতেই সিনেমাটি দেখা উচিত। গোটা ছবির বিরক্তি ওই একটি শটে মলম হয়ে ধরা দেবে। প্রতিটি সত্যিকারের মানুষের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠবে, গলা চেঁচিয়ে উঠবে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত সহযোগে 'এই তো'।।

আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী করমর্দন করবেন আমেরিকার প্রধানের সঙ্গে। দুই দেশের বেশ চুক্তি হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে বাণিজ্য দ্বিগুন করার লক্ষ্যে এগোবে দুই দেশ। ইন্ডিয়া-মিডল ইস্ট-ইউরোপ ইকনমিক করিডর বা আইমেক গঠন করার অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে আশার আলো দেখাবে দুই দেশ তাদের নাগরিকদের। ভারতকে ট্যাঙ্করোধী ‘জ্যাভলিন’ ক্ষেপণাস্ত্র দেওয়ার, এফ- ৩৫ বিমান দেওয়ার, আরও বেশি পরমাণু চুল্লি তৈরি করার, ২৬/১১ হামলার মূল চক্রী তাহাউর রানাকে দেশে আনতে দেওয়ার অঙ্গিকার করবে আমেরিকা। এদিকে ভারত সরকার আমেরিকান হুইস্কির উপর থেকে ৫০ শতাংশ কর তুলে বারবন হুইস্কির আমদানিতে এ বার থেকে ১০০ শতাংশ শুল্ক নেওয়ার অঙ্গিকার করবে। আমেরিকা থেকে অভিবাসীদের নিজের দেশে নিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সহমত হবে ভারত।

আসলে এই ধরনের বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে বৈঠক করে কোন দেশের যে কতটা লাভ হচ্ছে, তা আমাদের মত সাধারণ মানুষের ঠিকঠাক বোধগম্য হয়না। রাজধানী প্যারিসেও আইমেক নিয়ে বন্ধু তথা ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরেঁর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী। পরে এ প্রসঙ্গে মোদী বলেন, ‘‘ভারত, পশ্চিম এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যে কৌশলগত পণ্য বিশেষত জ্বালানি ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত মালপত্রের দেওয়া নেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা নেবে এই ইকনমিক করিডর।’’ আর্থিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আইমেকের কাজ ভারত এবং আমেরিকা যৌথ ভাবে এগিয়ে নিয়ে গেলে আখেরে লাভবান হবে নয়াদিল্লি। অতি অল্প সময়ে ভারতীয় পণ্যকে পশ্চিম, ইউরোপ এবং আমেরিকার বাজারে পৌঁছে দেবে এই ইকনমিক করিডর। আর্থিক বিশ্লেষকদের অপরদিকে দাবি, আইমেককে ইউএসআইমেকে বদলাতেই গাজার নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি ভাবে নিজের হাতে তুলে নিতে চাইছেন ট্রাম্প। এখন দেখার, ঠিক কী ঘটতে চলেছে।

এদিকে আমরা দেখলাম, সাংবাদিক বৈঠকে আদানির ঘুষ খাওয়া নিয়ে কোনও সাংবাদিক প্রশ্ন করলে প্রধানমন্ত্রী কি নিপুণতার সঙ্গে ভারতকে বসুধৈব কুটুম্বকম- এর ধারণায় বিশ্বাসী হিসেবে মেলে ধরে, বিষয়টি ভারতের ব্যক্তিগত (নিজের দেশের সমস্যা) বলে এড়িয়ে গেলেন কোনও সঠিক উত্তর না দিয়ে। আমরা সবাই জানি, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোনওরকম সাংবাদিক বৈঠকই করেননা। ভোটের আগে স্ক্রিপ্টেড কোয়েশ্চেন নিয়ে বাছা বাছা কয়েকটি চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দেন। আমরা সেটাই গিলি মাটন বিরিয়ানির মত। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগেনা? দেশের প্রধান সম্পূর্ণ নিজের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সব রকম কাজ করছেন, সব রকম অনুশাসন দিচ্ছেন, সবরকম মন্তব্য করছেন, তাঁকে প্রশ্ন করার কেউ নেই। ভারতের সংবিধান গণতন্ত্রের ধারক এবং বাহক- এই কী তার পরিচয়? আমাদের প্রশ্ন জাগেনা? সাধারণ, বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষ বুঁদ হয়ে থাকে ধর্ম নিয়ে। সনাতন ধর্মকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা অপরাধ এমনটাই মনে করছে খেটে খাওয়া মানুষ। আর আমরা রাজ্যে, কেন্দ্রে গণতন্ত্রের আড়ালে স্বৈরতন্ত্রের শাসনের সাম্রাজ্যে দিন কাটাচ্ছি হাসিমুখে। আমি নিজে দুঃখ বিলাসী নই, সদর্থকভাবে দিন যাপনেই বিশ্বাস করি এবং সবসময় ভালো আছি বলতেই পছন্দ করি। কিন্তু যা ঘটছে, তা সব ঠিক ঘটছে, তা তো বিশ্বাস করতে রাজি নই! জবাবদিহি কে নেবে? আমাদের সরকারের? শুধু বিধানসভায় বা লোকসভায় বা রাজ্যসভায় মাছ বাজার বসিয়ে বিরোধী সাংসদরা ঝগড়া করলেই জবাবদিহি চাওয়া হয়না। সততার সঙ্গে সরকার পরিচালনায় বাধ্য করতে গেলে সব রাজনৈতিক দলকেই সততার সঙ্গে চলতে হয়। যা ভাবাই এখন পাগলের ভাবনা!

কাজেই বলাই যায়, আমাদের মতো কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন (আমি নিজেকে মনে করি, এবং সমাজমাধ্যমে কিছু লেখা পড়ে মনে হয়, মুষ্টিমেয় হলেও এখনও কিছু মানুষ অবশিষ্ট রয়েছে, যাঁরা সত্যিকারের দুধকে দুধ এবং জলকে জল হিসেবে চিনতে পারে) মানুষ রাজনীতিকে দিনের পর দিন নিকৃষ্টতম বিষয় হিসেবে দেখতে শিখবে। তবে আগে বিষয়গুলো নিয়ে অসহিষ্ণু হলেও এখন এড়িয়ে চলিনা আমি রাজনীতি। নজরে রাখি, কবে দেশে কি হচ্ছে। বেশ নিজের দেশেই ভুলে ভরা ব্যাপারগুলোকে পাশ কাটিয়ে জীবনে এগিয়ে চলতে অভ্যাস করছি। যদি ফিরে যাই শুরুর টপিকে- সংসারের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে নারীদের করণীয় কী? চলো পাল্লা দিয়ে। বাড়ির কাজকেই কর্পোরেটের টাচ দাও, বাইরে কাজ করতে না দিলে বাড়িতে মাস মাইনের মতো সংসার খরচের রাস নিজের হাতে রাখো। নিজের শখ নিজের পূরণ করো। নিজেকে নিজেই গিফ্ট দাও, নিজেকে নিজেই ট্রিট দাও, নিজেই নিজের সঙ্গে ঘুরতে যাও। তবে হ্যাঁ, ওই সেক্ষেত্রে সংসারের পুরুষটিকে সেই বোধের জায়গাটিতে থাকতে হবে। হবেই। নইলে অবশ্যই সেপারেশন। আর আমার এই লেখায় ছবি বাছতে হিমশিম খাওয়ার জোগাড়!

প্রতিদিনের খবর এবং বিভিন্ন ফিচার ভিত্তিক লেখা, যেখানে খবরের সত্যতা তথা লেখনীর উৎকৃষ্টতা প্রাধান্য পায়। ফিচার ছাড়াও যে কোনও রকম লেখনী শুধুমাত্র উৎকৃষ্টতার নিরিখে গুরুত্ব পাবে এই সাইটে

Thanks for subscribing!

  • Whatsapp
  • Youtube
  • Instagram
  • Facebook
  • Twitter

The Conveyor

bottom of page