
স্বর্ণালী গোস্বামী
তপ্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিদিনই আমাদের চারপাশ কেমন যেন পাল্টে যাচ্ছে
গতকাল থেকেই ওয়েবকুপার বার্ষিক সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ধুন্ধুমার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। শনিবার ধিক্কার মিছিল বের করেছে তৃণমূল ছাত্র সংগঠন। সোমবার এসএফআই ধর্মঘট ডেকেছে। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি বন্ধের ডাক দিয়েছে। এদিকে সেদিন আবার শুরু হচ্ছে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা।
গতকাল আমি শহরে ছিলাম না। রাতে পোর্টালের খবর পড়তে গিয়ে এই খবর নজরে আসে। কি যে বলি এ বিষয়ে, তা যেন কিছুতেই কিছু বলা হবেনা বলে আমার মনে হচ্ছে। কারন সেখানে উপস্থিত ছিলেন আমাদের শিক্ষামন্ত্রী। ব্রাত্য বসুকে আমি মানুষ হিসেবে একজন বিদগ্ধ ব্যক্তি হিসেবেই মনে করতাম। কিন্তু তিনিও কেমন যেন যত দিন যাচ্ছে, ততই রাজনীতির মার্কামারা একজন হয়ে উঠছেন। শিক্ষিত, রুচিসম্পন্ন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিসত্ত্বাটি হারিয়ে যাচ্ছে, তাঁর মধ্যে থেকে, তা বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। আর যে কোনও এমন ব্লান্ডার ঘটলে উপযুক্ত সঙ্গত দেন আমাদের সকলের প্রিয় কুনাল ঘোষ মহাশয়! তিনি তো একেবারে উত্তেজিত হয়ে বললেন, কী করতেন শিক্ষামন্ত্রী কি আক্রমনের মধ্যে গাড়ি থামিয়ে মার খেতেন? কেন মিস্টার সাংবাদিক কুনাল ঘোষ? শিক্ষামন্ত্রীর চেয়ারে বসে একজন সাংস্কৃতিক রুচিসম্পন্ন ধীরস্থির মানুষ বাচ্চা বাচ্চা ছাত্রদের সামনে মার খেতে বেরোতে পারেন না বলে আপনার মনে হয়? সেটা করতে পারলে শিক্ষামন্ত্রী তো একটা নজির সৃষ্টি করতে পারতেন। আপনার তা মনে হয় না? তবে মনে হবেই বা কেন? আপনারা তো টাকা গিলবেন, দোহাই দেবেন আর পিঠ বাঁচাবেন, এমন রাজনীতিতেই বিশ্বাস করেন।
একটি সংবাদমাধ্যমে যদিও শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, "চালক ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কম বয়সি ছেলে। ওকে যখন ঘুঁষি মারছে। সামনের কাঁচটা ভেঙে গায়ে পড়ছে, ওরও গায়ে পড়েছে, আমার গায়েও পড়েছে। আমাদের আহত হওয়াটা ঠিক আছে। কিন্তু ছাত্রের আহত হওয়াটা কাম্য ছিল না।" তাও ভালো, এমন বাইট দিয়েছেন, বলেননি, 'আমার কী হত, যদি মারত ওরা?'
এদিকে শিক্ষামন্ত্রীর ‘গাড়ি চাপা’ পড়া পড়ুয়া জানালেন, ব্রাত্য বসু ওয়েবকুপার বার্ষিক সম্মেলনে এলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে পড়ুয়াদের সঙ্গে ছাত্রসংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করবেন। তখন ব্রাত্য বসুকে সবাই বৈঠকে বসার জন্য ঘিরে ধরে, তখন তৃণমূলের ছাত্র নেতারা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে ও শিক্ষামন্ত্রীকে তাঁর গাড়িতে তুলে দেয়। শিক্ষামন্ত্রী গাড়িতে উঠতেই গতি বাড়ায় চালক। আন্দোলনকারীরা অনেকবার তাঁকে থামতে বললেও নাকি গাড়ির গতিবেগ আরও বাড়ানো হয়। এখানেও একটা ব্যাপার। শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ি লক্ষ্য করে ইঁট ছুঁড়বে কেন ছাত্রেরা? গাড়ির কাঁচ ভাঙা হল কেন? গাড়িতে জুতো ছোঁড়া হল কেন? যাদবপুরের পড়ুয়াদের কাছে থেকে এমন অসহিষ্ণুতা আশা করা যায়না। শুধু রাজ্যেই নয়, দেশ তথা দেশের বাইরেও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটা সুনাম আছে। তারা এরকম অসহিষ্ণুতার মত, মারকুটে আচরণ করবে কেন? রাতে তৃণমূল সমর্থিত কর্মী সংগঠন ‘শিক্ষাবন্ধু’-র অফিসে আগুন লাগে। অভিযোগ, অফিসটিতে আগুন ধরানোর ঘটনায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী মহম্মদ সাহিল আলিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কেন? মুখে স্লোগান দিয়েও তো অনেক বিদ্রোহ করা যায়। পাড়ার অশিক্ষিত ছেলেদের মত ইঁট- পাটকেল ছোঁড়া তাদের মানায় বলে মনে করেন তাঁরা? তাহলে শিক্ষার গুরুত্ব কোথায়? যে কোনও বিষয়ে শালীনতা, সংযম শেখায় শিক্ষা। তা থাকছেনা কেন, বিদ্রোহ করার সময়?
ঘটনা নিয়ে ব্রাত্য বসু বলেন, "আমি আলোচনায় রাজি ছিলাম। এস এফ আই আমাকে এসে ডেপুটেশন দিয়েছে। কিন্তু ওরা চল্লিশ জনের সঙ্গে দেখা করতে বলে। আমি বলেছিলাম চার জনের সঙ্গে দেখা করব বলেছিলাম।। আমি পনেরো মিনিট অপেক্ষাও করি।’’ কেন? চল্লিশ হলে তাঁর সমস্যা হত কেন? ম্যানেজ করতে পারতেন না? কেন? বিভিন্ন ছাত্র বিভিন্ন কথা বলতে পারত? অসহনীয় হয়ে উঠতে পারত পরিবেশ? তাই কী ভেবেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী, তাই চারজনকে আসার অনুমতি দিয়েছিলেন? একটু সহনশীল হতে পারতেন না, আপনি? তাহলে হয়তো এমন বিচ্ছিরি একটা পরিস্থিতি না হতেও পারত।
আসলে প্রতিদিনই আমাদের চারপাশ কেমন যেন পাল্টে যাচ্ছে। আমরা যারা পুরোনো দিনের মানুষজন, তারাও সহনশীলতা হারাচ্ছি। একটা ব্যাপার আমি বিশ্বাস করি। একেবারে গুলি- বন্দুক- ছুরি নিয়ে অতর্কিত আক্রমন বাদে, যে কোনও বিদ্রোহের সামনে যদি পাথর কঠিন হয়ে চোখে চোখ রেখে কথা বলা যায়, দশটা উত্যক্ত কথার বিপরিতে একটা দৃঢ় কথার গুরুত্ব যথেষ্ট। সেই রকম আচরণ বিদ্রোহ কিছুটা হলেও ঠেকাতে পারে। জানিনা সেরকম সময় কখনও আসবে কি না, যখন আমরা বড়রা ছোটদের সামনে উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়ে বারবার তাদের বদ আচরণকে ঠান্ডা মাথায় ঠেকাতে সমর্থ হবো। তবেই একমাত্র সমাজের ভবিষ্যৎ সামলানো সম্ভব, নইলে সামনে সমূহ বিপদ।