
স্বর্ণালী গোস্বামী
3 Aug 2025
শিক্ষামন্ত্রী কোথায়? আপনি এই কাজটায় সম্মতি দিতে পারলেন? আপনার একবারও মনে হলনা, আমি পদত্যাগ করি? শুনলেই হাসি পায়, না?
জীবনের অর্ধশতক পেরিয়ে এসেছি। মেয়ে হয়ে জন্মানোর সুবাদে ছোটবেলা থেকে মায়ের শিক্ষা ছিল, ঘরের কাজে নিপুণ হতে হবে। সেলাই ফোঁড়াই শিখতে হবে। গান-বাজনা -পড়াশোনাও শিখতে হবে। সবেতেই চৌখস হতে হবে। মা- ই শিখিয়েছিল। ছোটবেলায় কেউই তো পড়াশোনা করতে চায় না, ভালো লাগেনা। যত পারা যায় ফাঁকি মারার প্রবণতা থাকে। আমরাও তার অন্যথা ছিলাম না। তবে আমাদের সময় আমাদের পরিবার তথা শিক্ষিত মহলে ছোটদের একটি প্রবাদ কানের মধ্যে গুঁজে দেওয়া হত, 'লেখাপড়া করে যে, গাড়ি- ঘোড়া চড়ে সে'। কাজেই লেখাপড়া তোমায় করতেই হবে। বড় হয়ে সমাজের একজন হয়ে ওঠার জন্য। চাকরি কথাটা ভূতের মত আমাদের পিছনে ছুটে বেড়াত না। হ্যাঁ, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, যেন আলাদা মানে রাখত আমাদের জীবনে। আজকের দুনিয়ার মত চক্ষুলজ্জার বিসর্জন দিয়ে 'টাকা কামানো'- আর 'নিজের পায়ে দাঁড়ানোর' শিক্ষার মধ্যে আকাশ- পাতাল ফারাক ছিল। ছিল বেড়ে ওঠার ফারাক, ছিল দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক, ছিল মূল্যবোধের ফারাক, ছিল ব্যক্তিত্ববোধের ফারাক, ছিল নীতিবোধের ফারাক, ছিল অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ না করার ফারাক, ছিল ঠিক কে ঠিক এবং ভুল কে ভুল বলতে পারার দৃঢ়তার ফারাক, ছিল বিবেকের ডাকে সাড়া দেওয়ার ফারাক ইত্যাদি এবং ইত্যাদি।
আমি নিজে অতীতের স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকার মতো মানুষ নই মোটেই, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে নতুন প্রজন্মকে বেড়ে উঠতে দেখতে, তাদের ঝরঝরে জীবনবোধকে কুর্নিশ করতে ভালোবাসি। কিন্তু বর্তমান সময়ে নতুন প্রজন্মকে শিক্ষা দেওয়ার প্রথাটাই তো পাল্টে গেছে। কি করে যে পাল্টালো, কিছু কিন্তু বুঝলাম না। আমরাই তো তাদের বড় করলাম, তাদের শিক্ষা দিলাম, তবে কেন এমন লাগামছাড়া নির্লজ্জ তৈরি হল এই প্রজন্ম? তবে কী শিক্ষাদানেই ফাঁকি ছিল, না কি গোটা সমাজটা ভেতরে ভেতরে ফাঁকা আওয়াজের কলসি হয়ে উঠল, যা আমি নিজের দায়িত্ব- কর্তব্য পূরণ করার ফাঁকে টেরই পেলাম না! বুঝিনা বিশ্বাস করুন, কিছুতেই মেলাতে পারিনা চারদিকের এই অধঃপতন! তবে কিছুটা কি আঁচ করতে পারি? একটা সময়ের ঘটনা এখানে বলতে খুব ইচ্ছে করছে। আমরা বেড়ে উঠছি, যেটা শুরুতেই বলেছিলাম, মা বলত, সবকিছু সমানভাবে নিপুণতার সঙ্গে শিখতে হবে এবং করতে হবে। ঘর ঝাঁট বা বাসন মাজাও এমনভাবে করতে হবে, সেটা যেন একটা শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। শিখেছিলাম সেভাবেই। শিখেছিলাম অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করা যাবেনা। বেড়ে উঠছি যখন, আমাদের বেড়ে ওঠা রেল কলোনিতে। বিভিন্ন জায়গায় বাবার ট্রান্সফার হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ইসলামপুরের আলুয়াবাড়ি রেল কলোনিতে থাকলেও আমাদের শুরু হয়েছিল কিষাণগঞ্জ থেকে (যদিও মা- বাবার বিয়ে হয় বাবা মনিহারিতে চাকরি করার সময়ে) কারন আমার এবং ভাইয়ের জন্ম ওখানেই এবং শুরুর অনেকটা বছর মা- বাবা ওখানে কাটিয়েছিলেন। ফলে বাবার চাকরিসূত্রে কয়েকজন বন্ধু ওখানে তৈরি হয়েছিল, এবং সেই কাকুদের সঙ্গে কাকিমারাও মায়ের বান্ধবী হয়ে গিয়েছিল। তো, আমাদের রেল কলোনিতে একটা রেওয়াজ ছিল মেয়ের বিয়ে মানেই ক্যাশ টাকা পণ দিতেই হবে। সঙ্গে যে যেমন পারবে, তেমন যৌতুক দেবে। শুরু থেকেই বাবা- মায়েরা খেয়ে- না খেয়ে টাকা জমাত নয়তো ধার করত। আমাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা মোটেই তেমন ছিলনা। মা যতটা সম্ভব আমাকে এবং ভাইকে স্বচ্ছলভাবে খাওয়া দাওয়া, বই- পত্র, গান- বাজনা শিখিয়ে, ইন্ডোর গেম কিনে দিয়ে গল্পের বই কিনে পড়ার অভ্যেস তৈরি করে বড় করছিল, যেটা রেল কলোনির সেই পরিবেশের সঙ্গে একেবারেই খাপ খায়নি।
হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর থেকেই সেই সময় মেয়েদের বিয়ে দেবার গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। সেই সময় ঠেকিয়ে রাখতে পারলেও গ্র্যাজুয়েশন করার পর তা আর কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। মা- বাবার চিন্তা পণের টাকা জোগাড় হবে কিভাবে! টাকা জমানোর কোনও মানসিকতাই ছিল না সেই সময় বাবা- মায়ের। ঠিকঠাক ছেলে- মেয়েকে মানুষ করাই মূল লক্ষ্য ছিল, কাজেই যেটুকু রোজগার হয়েছে তার সবটাই খরচ হয়ে গেছে। আমি তো তা বুঝতাম। আমি ছোট থেকেই একটু চুপচাপ কিন্তু বুঝদার ছিলাম। ভেতরে ছিল অদম্য জেদ, যা বাইরে থেকে কেউ দেখে বুঝতো না। তো আমি মা- কে পরিস্কার বলে দিলাম, আমি পণ দিয়ে বিয়ে করব না। মা তো হেসেই যেত, বলত বলে কি এই মেয়ে! বিয়েই হবে না তোর। কিন্তু আমি অনড় ছিলাম। চাউর হয়ে একটা সম্বন্ধ ভেঙে দিয়েছিলাম পণ চাওয়ায়। এবং অবশ্যই পণ না দিয়ে বিয়ে করেছিলাম। বিয়ের দিনে কিষাণগঞ্জের নিমন্ত্রিতদের মধ্যে সেই মায়ের বন্ধুদের মধ্যে একজন এক কাকিমা তা বিশ্বাসই করতে পারেননি। অচেনা- অজানা আমার ননদকে জিজ্ঞেস ই করেছিলেন উল্টো করে, তাঁর মেয়ের বিয়েতে কত যৌতুক দিতে হয়েছে তা বলে আক্ষেপ করে। আমার ননদের তখন সংক্ষিপ্ত উত্তর ছিল, অমন জায়গায় মেয়ের বিয়ে দিলেন কেন? আমার জীবনের এই ঘটনা নিয়ে আমি আমৃত্যু গর্ব অনুভব করব নিজের ভেতরে।
আসলে বিশাল এই সূচনা পর্বের উপস্থাপনা করলাম সাম্প্রতিক শিক্ষার পরিস্থিতি নিয়ে ভাবতে বসে। আমরা নিজেরা কেন আমাদের ছোটবেলার শিক্ষা জলাঞ্জলি দিয়ে এমন জড়ভরত আকন্ঠ অসামাজিক একটা প্রজন্ম তৈরি করলাম? তার পেছনে কী ওই সেই মধ্যবিত্ত কিছু মা- বাবার ভীরু সিদ্ধান্ত? যা কিনা ফেলাও যায়না অথচ গেলাও যায়না? রাজ্যের সরকারে উপবিষ্ট পার্টির যুব দলের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা পড়েছে। ছেলেপুলের দল আবদার করেছে সেই দিন পরীক্ষা ফেলা যাবেনা, তাহলে দলে যারা নাম লিখিয়েছে, তারা মোচ্ছব করতে পারবেনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান তাতে সম্মত না হওয়ায় ওপরমহলে জানিয়ে সেই ছেলেপুলেরা চিঠি করিয়েছে। উপাচার্য শান্তা দত্তের কাছে ২রা অগস্ট চিঠি পৌঁছেছে উচ্চ শিক্ষা দফতরের তরফে। চিঠিতে পরিস্কার বলা হয়েছে, ছাত্রদের তরফ থেকে বহু আবেদন এসেছে। সেদিনই তাঁরা পরীক্ষা দিতে চান না। তাই দিন বদলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী কোথায়? আপনি এই কাজটায় সম্মতি দিতে পারলেন? আপনার একবারও মনে হলনা, আমি পদত্যাগ করি? শুনলেই, হাসি পায় না? আপনি ছোটবেলা থেকে এই শিক্ষা পেয়ে বড় হননি? আমি হলফ করে বলতে পারি, এমনটাই শিখেছিলেন আপনি, যে শিক্ষা আগে, পার্টি করা তার পরে। কিন্তু এখন? আপনার সাফ উত্তর হবে যুগ পাল্টে গেছে। এখন আর ওই সব কচকচানি দিয়ে দিন চলবে না। কেন শিক্ষা মন্ত্রী? মুখ্যমন্ত্রীর কথা বাদই দিলাম। তিনি তো নিজেই অশিক্ষিতের মত চালচলন কথাবার্তা বলেন। কিন্তু আপনি? নিজের বিবেকের কাছে জবাবদিহি করতে পারছেন? এত বড় একটা অবনমন ঘটে গেল আপনার মধ্যে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময় একবারও ধাক্কা খাচ্ছেন না? এই শেখাচ্ছি আমরা পরের প্রজন্মকে?
আগামী ২৮ অগস্ট টিএমসিপির প্রতিষ্ঠা দিবস। ঘটনাচক্রে ওই দিনেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের স্নাতক স্তরে (বিকম) এবং আইন বিভাগের স্নাতক স্তরে (বিএ এলএলবি) চতুর্থ সেমিস্টারের পরীক্ষা রয়েছে। পরীক্ষা চলবে দুপুর ২টো থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। দলীয় কর্মসূচির দিনে কেন পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তৃণমূলের ছাত্রশাখা। কারণ, পরীক্ষার সেন্টার পড়ে অন্যত্র, তাই যাতায়াতে সমস্যা হতে পারে। একাধিক কলেজের অধ্যক্ষও এমন আশঙ্কা করছেন। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য শান্তা দত্ত দে–কে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি অবশ্য টিএমসিপি–র প্রতিষ্ঠা দিবস বলে ওই দিন পরীক্ষা বাতিলের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘কোনও দলের অনুষ্ঠান দেখে যদি পরীক্ষা সূচি বানাতে হয়, তা হলে তো সব দলের ক্ষেত্রেই তা দেখতে হবে। তা ছাড়া পরীক্ষাসূচি চূড়ান্ত করে বোর্ড অফ স্টাডিজ। পরীক্ষা নিয়ামক দফতরও ক্যালেন্ডারে সরকারি ছুটি বাদ দিয়ে রুটিন বানায়।
টিএমসিপি–র রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য বলছেন, বর্তমান ছাত্র-যুব সমাজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বিশ্বাসী। তাঁদের ‘আটকে দেওয়ার জন্য গভীর ষড়যন্ত্র’ করা হয়েছে। তৃণাঙ্কুর বলেন, ‘এ হলো ছাত্রছাত্রীদের গণতান্ত্রিক অধিকারে বাধা দেওয়া এবং দিল্লির ইশারায় চলার রাজনৈতিক অপকৌশল।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সিদ্ধান্তে টিএমসিপি কর্মী-সমর্থকদের পাশাপাশি সাধারণ পড়ুয়ারাও সমস্যায় পড়বেন বলে তৃণাঙ্কুরের আশঙ্কা। উপাচার্য শান্তা দত্ত দে বলছেন, এটা কোনও গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ নয়। বরং দলীয় অনুষ্ঠান দেখে পরীক্ষা নিতে হলে, সেটাই অগণতান্ত্রিক হতো।’ তিনি জানান, তিন মাস আগে পরীক্ষার দিন চূড়ান্ত হয়েছে এবং সবাইকেই এতে বসতে হবে।
অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরাও নিজেদের মাথা বিকিয়ে বসে আছেন? সবাই একযোগে এক কাজ করছেন বলে তো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সিদ্ধান্তটা ভুল হয়ে যেতে পারেনা? গোটা সমাজের প্রবীণেরা এমন ভয়ংকর একটা সিদ্ধান্তকে মান্যতা দিতে পারলেন? শিক্ষার থেকে দল কে উঁচুতে রাখতে পারলেন? কি শিখবে আজকের ছাত্রসমাজ? এই যে চারদিকে ছাত্ররা খুন- ধর্ষণ ইত্যাদি করছে, শিক্ষাব্যবস্থাই ধর্ষিত হচ্ছে, তার জন্য দায়ী কে? সমাজের প্রবীণদের মনে হয়না, দায় আপনাদের ওপর বর্তায়? সঠিক শিক্ষা আপনারা দিতে পারছেন, ছোটদের? সমাজ আজ ঘোরতর অমানিশায় আচ্ছন্ন, এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কি আমরা বুঝেই উঠতে পারছিনা। আমাদের সন্তানদের বলতে হচ্ছে, নিজেদের বিবেকের কথা শোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করো কিন্তু সমাজের পরিস্থিতি বুঝে, এবং অরাজকতা থেকে নিজেদের সরিয়ে নাও। এখানে আওয়াজ তুলে কোনও লাভ নেই, ফাঁকা আওয়াজ হবে, যে আওয়াজ তোমাদেরই কানকে বিষিয়ে তুলবে। নিজের জীবনে আদর্শকে ঠিক রাখো ব্যাস। এমনটা হচ্ছে কেন রাজনৈতিক দলে থাকা এবং বিভিন্ন পদাধিকার অলঙ্কৃত করে থাকা বিশিষ্টজনেরা বলতে পারবেন? আজকে সত্যিকারের শিক্ষিতরা দলে দলে রাজ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে! আমরাই ঠেলে পাঠাচ্ছি, ভয়ে। বিকিয়ে যাবে নইলে। আপনারা কি করছেন? গোটা রাজ্যের এমন কঙ্কালসার চেহারা দেখে ভয় পাচ্ছেন না? ইতিহাস আপনাদের ক্ষমা করবে না ভাবছেন না? কেন শুধু নিজেদের আখের গোছাচ্ছেন? কেন পারছেন না শান্তা দেবীর মত দৃঢ় অটল থাকতে? ওনাকে হয়ত শাস্তি দেওয়া হবে এই সিদ্ধান্তের জন্য। যেমন দেওয়া হয় মুষ্টিমেয় কিছু এখনও বিবেক বিসর্জন না দিয়ে ফেলা মানুষদের। কিন্তু তাঁরা নিজেদের জীবনে মাথা উঁচু করে থাকতে পারবেন এই আপোষ না করা মনোভাবের জন্য। আপনাদের মত শামুক হয়ে দিন কাটাতে হবেনা।



