স্বর্ণালী গোস্বামী
যে আন্দোলনটা বিশ্ব চাক্ষুষ করল, তা মোটেও ফেলে দেবার নয়
বছর শেষ হতে চলল। আর হাতে গোনা কয়েকটি দিন। এ বছর শুরু থেকেই পাদ- প্রদীপের আলোয় থেকেছে আমাদের রাজ্য। অবশ্যই ভালো কোনো কারনে নয়। সারা বিশ্বের কাছে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মাথা হেঁট হয়েছে রাজ্যের। শুরু হয়েছিল সেই সন্দেশখালি দিয়ে, আর শেষ হতে চলেছে আরজি করের ঘটনার শ্লথ গতির বিচার ব্যবস্থা নিয়ে।
তার মধ্যে ২০২৪ মনে থাকবেই গোটা বাংলা জুড়ে জন- জাগরণ ঘটেছিল আরজি করে কর্তব্যরত চিকিৎসকের নৃশংস খুন ও ধর্ষণকাণ্ডের প্রতিবাদকে ঘিরে। আসলে কোনও ইস্যু সামনে এলে তা এড়িয়ে যাওয়া যেন ইদানিং কালের বাঙালির মজ্জাগত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ডাল- ভাত টুকু খেয়ে ১০টা - ৫টা অফিস করে দিন যাপন করাই হয়ে উঠেছিল এ জাতির নিত্য অভ্যাস। সেই জড়ভরত বাঙালি যেন কোনও অমোঘ টানে পুরোনো বৈপ্লবিক ভাবমূর্তিতে জেগে উঠেছিল। সারা বিশ্বের কাছে নজির সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল এই জন- অভ্যুত্থান, যার নেপথ্যে ছিলেন মূলত জুনিয়র ডাক্তারেরা। তবে রাস্তায় নেমেছিল কিন্তু আপামর সাধারণ মানুষ থেকে সেলিব্রিটিরা। এমন কি শুরুর সময় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা বিশ্বের বাঙালি জাতির মধ্যে। যা এক কথায় ছিল অভিনব। এই বছর মনে রাখবে সকলে বাঙালির নব জাগরণের বছর হিসেবে। বাঙালির গণতন্ত্রের চেতনার বিকাশ হিসেবে। বাঙালির গলা তুলে আওয়াজ করার বছর হিসেবে। বাঙালির রাত জাগার স্পর্ধার বছর হিসেবে। দূর্গা পুজোর সময় বাঙালির এসপ্লানেডে গিয়ে বিক্ষোভের বছর হিসেবে। রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ঘুঘুর বাসার দাঁত বের করে দেবার সাহসের বছর হিসেবে। এ বছর বাঙালি মনে রেখে দেবে চিরটাকাল। অতীত হিসেবে ২০২৪ বাঙালির কাছে হয়ে থাকবে গর্বের একটা বছর।
আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গেল কেন বা সেই আন্দোলন থেকে আমরা কী পেলাম, তার বিচার সময় করবে, কিন্তু যে আন্দোলনটা বিশ্ব চাক্ষুষ করল, তা মোটেও ফেলে দেবার নয়। অভয়ার বিচার সঠিকভাবে হল কি না, তাও সময় বলবে, সাধারণ মানুষের হাতে তার বিচারের ক্ষমতা নেই। সন্দীপ ঘোষ জামিন পেয়ে গেল মানেই আন্দোলন বৃথা তা কখনওই হতে পারেনা। হয়ত এক আঙ্গিক থেকে আন্দোলনের সারমর্ম কিছু বেরোয়নি, তবুও স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন হয়েছিল এটা অস্বীকার করার উপায় নেই কারও, তা ইতিহাসের একজন ছাত্রী এবং মিডিয়া কর্মী হিসেবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। যাঁরা এই আন্দোলনকে লঘু করে দেখার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের মেরুদন্ডই নেই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দম নেই। পচা- গলা সিস্টেমের বিরুদ্ধাচরণ করার সাহস নেই। আজ তাদের জন্যই বাঙালিরা পিছোতে পিছোতে দেওয়ালে পিঠ থেকে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে। কেউ কেউ উচ্চ পদে আসীন হয়েও নিজেদের স্বার্থকে ত্বরান্বিত করার জন্য এই আন্দোলন লঘু করে ভাবানোর এবং দেখানোর মরিয়া প্রয়াস করেছেন। তাতে আন্দোলনের মহিমা বিন্দুমাত্র কলুষিত হবেনা। আমার বিশ্বাস এই মুহূর্তে যেমন ডাক্তারেরা ফের ডোরিনা ক্রসিংয়ে আন্দোলনের মশাল জ্বালিয়ে রাখছেন, তেমনই এই মশাল কখনও দাউ দাউ করে আবার কখনও ধিকি ধিকি ঠিক জ্বলবে যতক্ষন না অভয়া বিচার পায়। আসলে কাজে ফিরতে হবে প্রত্যেককেই, এটা শুনতে খারাপ লাগলেও কঠিন বাস্তব। তাই কাজের মধ্যে থেকেই আন্দোলন চলবে ঠিক।
বছরের শেষে ইনফোসিস শহরে তাদের নতুন অফিস খুলল। তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে এ এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক তা বলাই বাহুল্য। মন্দার বাজারে নতুন কোম্পানির আগমন শহরের বেকার যুবক- যুবতীদের আশার আলো দেখাবে।
আমরা শুধু রাজ্যে বা দেশে নয়, সমগ্র বিশ্বেই এ বছর অনিশ্চয়তার কালো মেঘ দেখেছি। তা সে ইরান- ইরাক, প্যালেস্টাইন, ইসরায়েল, হামাস, গাজা, রাশিয়া, ইউক্রেন, সিরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা যাই বলুন, চারিদিকে অশান্তির আঁচ পেয়েছি আমরা বছরভর। গতকালও দেখলাম ইউক্রেনের একটি ড্রোন রাশিয়ার কাজানে এক বহুতলে ৯/১১ র কায়দায় হামলা ঘটাল। মানুষ শান্তিতে বাঁচবে কীভাবে? যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশগুলোর সাধারণ নাগরিকদের দিকে তাকানো যায়না। কি বীভৎস এক- একটা মর্মান্তিক মৃত্যু! চারদিকে রাজনৈতিক চাপান- উতোর। প্রায় প্রতিটা শক্তিশালী দেশ তুলনামূলক দুর্বল দেশে আক্রমন ঘটিয়ে অমানবিক এক জিঘাংসার পরিচয় দিচ্ছে।
পাশের রাজ্য বাংলাদেশেই ঘটল এক বিপর্যয়। শুরুতে মনে হয়েছিল হয়ত নতুন, খুব ভালো কিছু ঘটবে। কারন, সত্যিই শেখ হাসিনার সরকার যেভাবে শেষের দিকের ভোট পরিচালনা করছিলেন, তা মোটেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ঘটছিলনা, তা আমরা সকলেই বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু যত দিন এগিয়েছে, তত নতুন ক্ষমতা নেওয়া ইউনুস সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতা নজরে এসেছে। বাঙালি হিন্দুদের ওপর অকথ্য অত্যাচার সে দেশের কলঙ্ক বাড়িয়েছে বই কমায়নি। শান্তির ক্ষেত্রে নোবেল পাওয়া একজন ব্যক্তি কিভাবে এত অশান্তির প্রশ্রয় দিতে পারে, তা ভেবেই অবাক লেগেছে। গোটা দেশ সারা বিশ্বের কাছে এক হাস্যকর পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তাদের নিজেদেরই সে বিষয়ে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই।
তবু এভাবেই সময় এগিয়ে চলবে। আমাদের নিজের নিজের জীবন এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। নিজেদের বিবেককে জলাঞ্জলি না দিয়ে যদি জীবনের শেষ দিন অব্দি বাঁচতে পারি, তবেই জীবন সার্থক হবে। এই সমস্যাগুলো এড়িয়ে না গিয়ে সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থেকে তার থেকে পরিত্রানের উপায় খোঁজার মধ্যেই যদি জীবনের কিছুটা সময় অন্তত দিতে পারি আমরা সকলে, তবে স্বার্থপর এই পৃথিবীতে কিছুটা হলেও মানবিকতার পরিচয় দেওয়া যাবে। মানুষে মানুষে বিদ্বেষ এখন অতি স্বাভাবিক একটা বিষয়। সেটা যদি ভবিষ্যতে আমরা কাটিয়ে উঠে মানবিকতার পরিচয় দিতে পারি, তবেই হয়ত এমন একটা বছর আর আমাদের দেখতে হবেনা।