স্বর্ণালী গোস্বামী
নরেন্দ্র মোদী তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হলেন
নরেন্দ্র মোদী তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হলেন। অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন এ বছর শুরু হয়েছিল গত ১৯ এপ্রিল। শেষ হয় ১ জুন। দীর্ঘ সময় ধরে এবারের নির্বাচন রাজ্যের নিরিখে যেমন তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, তেমনি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল কেন্দ্র তথা দেশের নিরিখেও।
বছরের শুরুতেই সন্দেশখালিতে তৃণমূল নেতৃত্ব বিশেষ করে শেখ শাহজাহান ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের বিরুদ্ধে স্থানীয় মহিলারা রুখে দাঁড়িয়েছিল। বিস্ফোরক দাবি করেছিল তারা, গ্রামের মহিলাদের সম্ভ্রম নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে তৃণমূলের লোকজন, এমনিই ছিল অভিযোগ। তার আগে ইডি শাহজাহানের বাড়ি রেইড করতে গেলে ইডির আধিকারিকদের তাড়া করা হয়। শাহজাহান বহুদিন নিরুদ্দেশ থাকার পর তাকে কব্জা করে পুলিশ। সারা দেশ জুড়ে সন্দেশখালি খবরের শিরোনামে চলে আসে। ফলে ব্যাকফুটে চলে গিয়েছিল তৃণমূল স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু যত দিন গড়িয়েছে তৃণমূল নিজের জমি শক্ত করার উপায় বের করতে করতে এগিয়েছে। শেষের দিকে একটি ভিডিও প্রকাশ্যে আসে, যেখানে বিজেপি অভিসন্ধি করে মহিলাদের পুলিশের কাছে পাঠিয়েছে বলে বিজেপির কর্মীকে বলতে শোনা যায়। খেলা ঘুরে যায় সেখান থেকেই।
তারপর তোলপাড় পরে যায় ইলেকটোরাল বন্ডের ভূমিকা নিয়ে। বিজেপি যথেচ্ছভাবে টাকা আমদানি করেছে এই বন্ডের মাধ্যমে, যা অবশ্যই দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হতে বাধ্য। কম যায়না আমাদের রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেসও।
বিজেপি সিএএ চালু করে ভোটের প্রচার শুরু হতেই। কিছু মানুষ তাতে সায় দিলেও বেশিরভাবগ মানুষ এই আইনের বিরোধিতায় চলে যায়। দিল্লিতে কেজরিওয়ালের গ্রেফতারি বিজেপিকে খানিকটা হলেও ব্যাকফুটে নিয়ে যায়। এরপর এপ্রিলের শেষের দিকে কংগ্রেসের ইস্তেহার প্রকাশের পর নরেন্দ্র মোদী আলিগড়ে একটি সমাবেশে বলেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন যে কংগ্রেসের ইশতেহারে বলা হয়েছে যে তারা মা-বোনদের সাথে সোনার হিসাব করবে, সে সম্পর্কে তথ্য পাবে এবং তারপর সেই সম্পত্তি বণ্টন করবে। হিন্দুদের থেকে 'মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নেবে'। এই উক্তি হিন্দি বলয়ের হিন্দুদের আঁতে ঘা লাগার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ছিল।
এরকম বিভিন্ন কারনে জনমত কিন্তু ভাগ হয়ে যাচ্ছিল। মূল মিডিয়া তেমন গুরুত্ব না দিলেও বিভিন্ন ইউটিউবাররা দেশের গণতন্ত্র রক্ষা করার তাগিদে নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে গেছে সাধারণ মানুষকে জাগ্রত করার জন্য। এদিকে আমাদের রাজ্যে এত দুর্নীতিতে ডুবে থাকা সরকার হলেও শুধুমাত্র বিজেপিকে ঠেকাতে মানুষ শেষ মুহূর্তে নিজেদের মত পাল্টে ফেলেছিল নিশ্চয়ই। তাছাড়া ছিল রাজ্যের মহিলা ভোটব্যাংক। একটা বিরাট মহিলা ভোটব্যাংক তাদের লক্ষ্মীর ভান্ডারের অর্থ হাতছাড়া না করতে চেয়ে তৃণমূলেই আস্থা রেখেছে। লড়াইয়ে ছিল বাং- কংগ্রেস জোট। তবে যেমনটা ভাবা হয়েছিল, তেমন ভোট কিন্তু কাড়তে পারেনি তারা। হয়ত রাজ্যের মানুষের আস্থা এখনও অর্জন করতে পারেনি এই জোট।
শেষ দিনের ভোটদান পর্ব মিটে যাওয়ার পর চ্যানেলে চ্যানেলে শুরু হয়ে যায় এক্সিট পোল। আমার যখন রাজনীতিতে আগ্রহ একেবারেই ছিল না, তখনও আমি প্রণয় রায় এবং বিনোদ দুয়া'র ভোট পরবর্তী বিশ্লেষণমূলক এই ধরনের এক্সিট পোল সংক্রান্ত আলোচনা শুনতাম। খুব ইন্টারেস্টিং লাগত তাঁদের উপস্থাপনা। এখন তো বিভিন্ন সংস্থা হয়ে গেছে, তারাই কর্পোরেট ধাঁচে এক্সিট পোলের হিসেবে নিকেশ করে। যদিও তার ভিত্তিতে রেজাল্ট হয়না। কিন্তু কম- বেশি সেই তথ্য মিলেও যায়। কিন্তু এবারে যেটা হল, তা হল একেবারে পাশা উল্টে দিয়ে গোটা দেশের জনমত দেখা গেল ভিন্ন রাস্তায় হেঁটেছে। সর্বসম্মতিক্রমে ফের বিজেপি কেন্দ্রে আসছে এমনিই রায় ছিল এক্সিট পোলে। কিন্তু দেখা গেল, গত দু'বার যেভাবে বিজেপি নিজেরাই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে সরকার গড়েছিল, এবারে আর তা হলনা।
বিভিন্ন রাজ্যের বিজেপি বিরোধী দলগুলি যখন 'ইন্ডিয়া' গঠন করল, সাততাড়াতাড়ি শিয়রে সমন বুঝে বিজেপিও তাদের প্রায় ভুলতে বসা জোটসঙ্গীদের নিয়ে এনডিএ গঠন করে ফের ভোট করার পরিকল্পনা করলেও, ইন্ডিয়া জোটকে গুরুত্ব দিতে একেবারে নারাজ ছিল। তবে ওই যে শুরুতেই যেটা বললাম, দিন যত এগিয়েছে, বিজেপির দম্ভ যেন কমতে কমতে গেছে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফলাফল ঘোষণার দিন সকাল থেকেই দেখা যেতে লাগল বোড়ের চাল অন্য দিকে গেছে। রাজ্যে তৃণমূল বিপুল জনসমর্থন পেল, অপরদিকে দেশে বিজেপিকে ২৪০ আসনেই সন্তুষ্ট থাকতে হল। ডায়মন্ড হারবারে ৭ লাখেরও বেশি ভোটে জিতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দেশের মধ্যে রেকর্ড ভোটে জিতলেন।রাজ্যে ২০১৯ এর ১৮ র তুলনায় বিজেপি কমে দাঁড়াল ১২ তে। কংগ্রেস রাজ্যে ভালো ফল না করলেও দেশে পেল ৯৯ টি আসন। যা তাদের মনোবল বাড়ানোর পক্ষে যথেষ্ট। আরও জেতার আশা করেছিল ইন্ডিয়া জোট, কিন্তু এই বা কম কী? ২৩৪ টি আসন পেল তারা। রাজ্যে বেশ কিছু নক্ষত্র পতন হল। দিলীপ ঘোষ, লকেট চ্যাটার্জী, অর্জুন সিং, নিশীথ প্রামাণিক এবং কংগ্রেসের অধীর চৌধুরীকে হারের মুখ দেখতে হল। অপরদিকে অমেঠিতে হারলেন স্মৃতি ইরানি, উত্তর প্রদেশে আদিত্যনাথকে আউট করে ছক্কা হাঁকালেন অখিলেশ যাদব। কিন্তু আর একটাও অপ্রত্যাশিত ফল হল ওড়িশায়। যে নবীন পট্টনায়ক ওড়িশাকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন, সেই নবীনের দল মাত্র একটি আসন পেল রাজ্যের বিধানসভায়। সেখানে বিজেপি সরকার গড়বে। অন্ধ্রপ্রদেশে কিন্তু চন্দ্রবাবু নাইডু ফের জিতে এনডিএ তে গুরুত্বপূর্ণ শরিক হলেন। আবার বছর শুরু হয়েছিল যেখানে রাম রাম ধ্বনিতে, সেই অযোধ্যায় হারের মুখ দেখতে হল বিজেপিকে। এই দিন তিনেক আগে পুরীর শঙ্করাচার্যের এক বক্তৃতায় শোনা গেল, মন্দিরের পুরোহিতেরা অযোধ্যার রাম মন্দির উদ্বোধনে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা মেনে নিতে পারেননি। গোঁড়া হিন্দুদের কাছে তা বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে। কোনও প্রথিতযশা পুরোহিতকে দিয়ে মন্দির উদ্বোধন করালে ফল অন্যরকম হলেও হতে পারত।
যেটা প্রাপ্তি হল এবারের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে, তা হল কোয়ালিশন গভর্নমেন্ট ফের শুরু হচ্ছে, বিজেপি একচ্ছত্র ভাবে স্বৈরাচারী কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বিরোধীশূন্য কক্ষে আইন পাশ করিয়ে নিতে পারবেনা। শরিকের সঙ্গে মাইল মিশে চলতে হবে। পাশাপাশি একটা শক্তপোক্ত বিরোধী দল গঠিত হচ্ছে শাসক দলকে সমঝে চলতে বাধ্য করতে। আমাদের মত দেশে, যেখানে বৃহৎ গণতন্ত্র রয়েছে, সেখানে ধর্মের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত বা স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত কখনোই কাম্য হতে পারেনা। আশা করব আগামী পাঁচ বছর এই সরকার সুচারুভাবে সরকার চালাবে এবং গোটা সময়টা পূরণ করবে।