
স্ব র্ণালী গোস্বামী
5 Oct 2025
এ কেমন প্রশাসন? যারা সাধারণ মানুষের ভয়াবহতার সামনে উৎসবকে প্রাধান্য না দিয়ে মানুষের বিপন্নতাকে প্রাধান্য দিতে পারে না?
পুজোর আগেই আমি ভিডিওয় বলেছিলাম, শহরে বন্যায় যেমন মানুষের প্রাণ গেছে, তেমনি ক্ষতি হয়েছে প্রচুর মানুষের। তবু মা দুর্গা যেন রক্ষা করেন আমাদের, আমরা যেন এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে পারি। পুজোর মধ্যে দুর্যোগের পূর্বাভাস থাকলেও তেমন তেমন ক্ষয় ক্ষতি হয়নি, দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি জেলার কিছু জায়গা ছাড়া। কিন্তু পুজো কাটতে না কাটতেই উত্তরবঙ্গের ভয়াবহতা আমাদের হতবাক করে দিয়েছে। গতকালের বৃষ্টির ফলে গোটা উত্তরবঙ্গ সহ পাহাড়ি অঞ্চল, ভুটান একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
এদিকে আজই পালিত হচ্ছে দুর্গাপুজোর কার্নিভ্যাল। এ প্রসঙ্গে একটা কথা, সাধারণ মানুষ হিসেবেও কি চোখে লাগেনা, রাজ্যের এক প্রান্তের মানুষের হাহাকারের পাশাপাশি এক প্রান্তের মানুষের উচ্ছাস! টিভিতে দেখছিলাম কিছুক্ষন আজকের ঘটনার ঘনঘটা। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী মিছিল করছেন শহরের বন্যায় ১২ জনের মৃত্যুর প্রতিবাদে। পাশাপাশি তিনি উত্তরবঙ্গের বন্যা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। অপরদিকে কুনাল ঘোষ বলছেন, নাকি সস্তার রাজনীতি করা হচ্ছে! কুণালবাবু, বলুন তো, ঠিক এই জায়গার পাল্টাপাল্টি হলে আপনি কি করতেন? ঘরে ঢুকে মিটিমিটি হাসতে হাসতে কার্নিভ্যাল দেখতেন, নাকি শাপশাপান্ত করতেন এই উৎসবের? এক বছর উৎসব স্থগিত করা যেত না, উত্তরবঙ্গের মানুষদের স্বার্থে? তাহলে এ কেমন প্রশাসন? যারা সাধারণ মানুষের ভয়াবহতার সামনে উৎসবকে প্রাধান্য না দিয়ে মানুষের বিপন্নতাকে প্রাধান্য দিতে পারে না? আপনি বলছেন, বিদেশ থেকে অতিথিরা এসেছেন। তাঁদের কি বলা যেত না, এমার্জেন্সি পরিস্থিতিতে কার্নিভ্যাল এ বছর হবেনা! তারা কি নিজেরা দেখছেন না, শুনছেন না, রাজ্যের অপর প্রান্তে মানুষের মৃত্যু মিছিল চলছে? তারা কি মানবিক সরকারের পরিচয় পাচ্ছে? আমি হলফ করে বলতে পারি, যদি কেউ সত্যিকারের মানুষ হয়, তাহলে মানুষের অসহায়তায় তাদের প্রাণ কাঁদবে। নইলে ভালো- মন্দ খাইয়ে বিদায় করুন তাদের। লাগেনা ওই রকম অতিথি!
দুর্যোগের জেরে বিপর্যস্ত পাহাড়ের বড় অংশ। সড়ক পথ, রেলপথ সব বন্ধ হয়ে গেছে। মিরিকের লাইফলাইন ১৯৬০ এর দশকের আমাদের অতি পরিচিত দুধিয়া সেতুর পিলার ভেঙে পড়েছে। আটকে পড়েছেন বহু পর্যটক। কত জন পর্যটক উত্তরবঙ্গে আটকে পড়েছেন, সেই সংক্রান্ত তথ্য সরকারি ভাবে এখনও পাওয়া না গেলেও, সংখ্যাটা যে খুব কম নয়, তা মানছেন অনেকেই। ডুয়ার্সে হাতির মাধ্যমে পর্যটকদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসা হচ্ছে। প্রশাসনিক সূত্রে খবর, মিরিক সৌরেনিতে আটকে পড়া পর্যটকদের নল-পটং-লোহাগড় হয়ে শিলিগুড়িতে পাঠানো হচ্ছে। ধস নামায় শিলিগুড়ি-দার্জিলিং রোহিণী রোড বন্ধ। বিপর্যস্ত হিলকার্ট রোড। ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ চলছে। তবে শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী এখনও পর্যন্ত পাঙ্খাবাড়ি রোড খোলা। খোলা দার্জিলিং থেকে মংপু হয়ে শিলিগুড়ি যাওয়ার রাস্তা। যানবাহন চলাচল করতে পারছে মিরিক-পশুপতি-ঘুম-কার্শিয়াঙের রাস্তাতেও।
জলদাপাড়ার হলং কার্যত জলের নীচে। ভেঙে পড়েছে হলং সেতু। কাঠের সেতু ছাপিয়ে হু হু করে বইছে নদীর জল। জলদাপাড়া টুরিস্ট লজের ছবিটাও ভয়ঙ্কর। একেবারে জলের তলায়। পুজোর মরশুমে পর্যটকরা এসে আটকে পড়েছেন। বিজনবাড়ি সেতুর নীচ দিয়ে বইছে জলের স্রোত। বিপর্যস্ত বন্যপ্রাণও। জিটিএ-এর তরফে এই লেখা অব্দি পাওয়া খবর অনুসারে ২৪ জনের মৃত্যুর কথা বলা হচ্ছে। নিখোঁজ বহু। টানা বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত দার্জিলিং, অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ সমস্ত পর্যটনকেন্দ্র। এদিকে ডুয়ার্স এলাকায় ভারী বৃষ্টির পাশাপাশি অতিভারী বৃষ্টিপাত দেখা গিয়েছে ভুটানে। ওয়াংচু নদীর জল উপচে পড়েছে ফুন্টশলিং তালা বাঁধের ওপর। ভুটান প্রশাসনের পক্ষ থেকে লাল সতর্কতা জারি করা হয়েছে। আগামীকালও আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি জেলায় ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। পর্যটকদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে প্রশাসনের তরফে তাঁদের গন্তব্যে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।
উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিকে নিয়ে আজ জরুরি বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। জেলা প্রশাসনগুলি থেকে বিস্তারিত রিপোর্ট নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ত্রাণ সামগ্রী থেকে শুরু করে সব রকমের পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ মুখ্যমন্ত্রীর। আগামীকাল তিনি উত্তরবঙ্গে যাচ্ছেন মুখ্যসচিবকে নিয়ে। বিজেপির তরফেও আগামীকাল শমিক ভট্টাচার্য যাচ্ছেন উত্তরবঙ্গে। উত্তরবঙ্গে বিপর্যয় নিয়ে টুইট প্রধানমন্ত্রীর! দুর্যোগে মৃতদের সমবেদনা জানালেন মোদি। বিপর্যস্ত উত্তরবঙ্গে সোমবারও হবে ভারী বৃষ্টি, বলছে আবহাওয়া দফতর।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে আজকের কার্নিভ্যালে ছিল তারকার হাট। বাংলার শিল্প-সাহিত্য- সংস্কৃতি-কৃষ্টি সহ বিভিন্ন জগতের বিশিষ্টজনেরা অংশগ্রহণ করেছেন এই মেগা কার্নিভ্যালে। অনুষ্ঠানে বেশ-বিদেশের বিশিষ্টজনদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমন্ত্রিতের তালিকায় আছেন ইউনেস্কোর প্রতিনিধিরাও। ছিলেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডররা। রেড রোডের দু’দিকে ২০ হাজার দর্শক বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মূল মঞ্চের সামনে হয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রত্যেক পুজো কমিটিকে দু’মিনিট করে সময় দেওয়া হয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্য। এই প্রথম ১০০ টির বেশি পুজো উদ্যোক্তা কার্নিভ্যালে অংশগ্রহন করেছে।
‘খোলা হাওয়া’ নামে এক সংগঠনের ডাকে পাল্টা মিছিলের ডাক দেওয়া হয়েছিল এদিন। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ওই মিছিলে হেঁটেছেন এবং রাজ্য সরকারকে তুলোধোনা করেছেন। যেতে যেতে আবারও বলব, যাঁরা আজকের এই প্রতিবেদন পড়ছেন, তাঁরা বলুন তো, রাজ্যের সরকারের কোনদিকটাতে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল? ঐতিহ্যের উৎসবে, নাকি সাধারণ মানুষের কাতর আবেদনে? এই ঐতিহ্যতো কিছু কাজের মাধ্যমে ধারণ করা হচ্ছে না, পালন করা হচ্ছে উৎসবের মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে এ বছর বন্যায় দুর্গতদের আর্তি শুনে উৎসব স্থগিত রাখলে মানুষের মানবিকতাকে গুরুত্ব দেওয়া হত এবং সরকারের মানবিক রূপ প্রকাশ পেত। যা এখন বিলুপ্ত হতে বসেছে শুধু কেন্দ্রের সরকারের ঘাড়ে চিৎকার- চেঁচামেচি করে দোষ চাপাতে চাপাতে। নিজেদেরও কিছু করণীয় কর্তব্য থাকে, সেদিকে নজর দেওয়াটাই প্রতিটি দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হওয়া উচিত।



