
স্বর্ণালী গোস্বামী
বিশ্বভারতীর হেরিটেজ তকমা, গর্বের এবং আনন্দের। যা উদ্বেল করে মনকে
ঐতিহ্য শব্দটার মধ্যেই আমার একটা দুর্বলতা আছে। সেটা আমি ছোট থেকেই অনুভব করি। আমার জীবনে আধুনিকতা আসে ঐতিহ্যের হাত ধরে। যে আধুনিকতায় মত্ততা রয়েছে, সেটাকে কোনোদিনই আমি আপন করে নিতে পারিনি। শুধু তো এই ২০২৩ এই নয়, আমাদের সময়েও মত্ততা ছিল, কিন্তু সেই পাত্রের আকারে কোনওভাবেই নিজেকে গড়ে নিতে পারিনি, তাই সকলের পছন্দের ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারিনি কোনওদিনই।
একটু বোকা-সোকা গোছের আমি বরাবরই। তবে নিজের বুদ্ধির ওপর আমার আস্থা আছে। আগেও ছিল, এখনও আছে। স্বাভাবিকভাবেই যে সংস্কৃতি, যে কৃষ্টি মনকে ঋদ্ধ করে, সমৃদ্ধ করে, তার অন্বেষণ করে গেছি আমি বরাবর। সেক্ষেত্রে আমার তথাকথিত প্রফেশনালি গান বা নাচ না শেখা মা যখন পাড়ার উৎসাহী বাচ্চাদের নিয়ে একটা গোটা ফাংশন নামিয়ে দিত, বা রেডিয়োয় শুনে শুনে গীতবিতানের প্রায় সমস্ত গান বাড়ির আবহে গাওয়ার যোগ্য তৈরি করে ফেলত তখন তার মেয়ে হয়ে সেই আবহের আঁচ আমার মধ্যেও পড়বে তা আর আশ্চর্যের কী? তবে নিজের মাত্র ছ'বছরের গানের তালিম নিয়ে বা সাত বছরের সেতারের তালিম নিয়ে সঙ্গীতজ্ঞ হওয়ার বাসনা আমার কোনোকালেই ছিলনা। তবে একনিষ্ঠ সঙ্গীতানুরাগী হতে গেলেও কিছুটা তালিমের প্রয়োজন বলে আমি বিশ্বাস করি। এছাড়া নিজের মত করে গাইতে তো কোনও অসুবিধে নেই। সেটা বজায় রেখেছি। এবং সেখান থেকেই যত দিন এগিয়েছে, বিষয়টা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার ব্যাপ্তি দিয়েছি নিজেকে। তাই এখনও মনকে শান্ত রাখে, খুশি রাখে, দৃঢ় রাখে যে সংগীত, তার মধ্যেই নিজেকে খুঁজে পাই।
এত ভণিতা করছি একটি খবরকে নিয়ে। হয়ত একটু বিষয় থেকে সরেও গেলাম অতি আবেগে। সে যাকগে, মাঝে মাঝে আবেগতাড়িত হয়ে পড়লে মনে হয়, নিজের মধ্যে এখনও অবুঝ আমিটা রয়েছে, যে ভাবনার মধ্যে খেই হারিয়ে ফেলে। আসল কথা হল বিশ্বভারতীর ইউনেস্কোর তরফে হেরিটেজ তকমা পাওয়া। এই খবরটাই আমাকে উদ্বেলিত করেছে এতটা। বিশ্বভারতীকে চিনেছি অনেক পরে। তবে গীতবিতান এবং রেডিওর রবীন্দ্রসঙ্গীতের সূত্র ধরে এই নামটির সঙ্গে পরিচয় ছোট থেকেই। তবে তা ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। বড় হতে হতে চিনেছি। গল্প শুনেছি মাস্টারমশাই সুবিমল সরকারের কাছ থেকে। তারপর সম্পদদা গেল শান্তিনিকেতনে গান শিখতে। এসে গল্প করত ওখানকার। সম্ভবত কণিকা বন্দ্যেপাধ্যায় বা পূর্বা দাম-এর কাছে শিখত (মা বলত একটু বাড়িয়ে, রং চড়িয়ে কথা বলে সম্পদ দা। তাই বিশ্বাসযোগ্যতা কম কথার। বেশ খানিকটা বয়সে বড় ছিল)। কাজেই গল্প হিসেবেই ধরতাম। তবু সত্যি, মিথ্যে মিলিয়ে খোদ শান্তিনিকেতনের গল্প তো! ইসলামপুরের পাবলিক হলে বিভিন্ন ফাংশন করেছি সম্পদদা, গৌরদা, পলাদি দের সঙ্গে। পরে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর আমাদের রত্না চলে গেল শান্তিনিকেতনে ইতিহাস নিয়ে পড়তে। এবার যেন বেশ অনেকটাই কাছের হয়ে গেল জায়গাটা। রত্না আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল। চোখের সামনে দেখতে পেলাম ওর মধ্যেকার বদল। একেবারে অগোছালো মেয়েটা কিভাবে বেশ শৌখিন হয়ে উঠল। পছন্দসই পোশাক, সাজগোজ- সবেতেই যে জায়গাটা প্রভাব ফেলেছে, তা বোঝাই যায়। রত্না নিজেও বলত।
তারপর কলেজে অনার্স পেপারের জন্য তিনমাস টিউশন পড়েছিলাম শ্রী অশোক সরকারের কাছে। ওই স্যার আমার মনন তৈরিতে অনেকটাই ভূমিকা নিয়েছিলেন তা স্বীকার করতেই হয়। হস্টেলে থাকতাম, অন্যান্য স্টুডেন্টদের তুলনায় কাছেই আমার বাস। তাই বেশিরভাগ দিন সবার আগে পৌঁছে যেতাম। স্যার এবং গার্গী ম্যাডাম বিশ্বভারতীতে পড়াশুনা করা। দুজনেই ওখান থেকেই মাস্টার্স করেছিলেন। ফার্স্টক্লাস পেয়েছিলেন দুজনেই। দুজনের কথার মধ্যেই একটা আলাদা নমনীয়তা ছিল। যা আমি সেই সময়ে আমার পরিচিত মহলে আগে কোনওজায়গায় বা কারোর মধ্যে পাইনি। আভিজাত্য, নমনীয়তা, ভদ্রতা এবং দৃঢ়তার এক অদ্ভুত মিশেল ছিল বিশেষ করে স্যারের চরিত্রে। আমার কেন যেন মনে হয়েছিল, এ শান্তিনিকেতনের প্রভাব। হয়ত নাও হতে পারে, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে তা ছিল শান্তিনিকেতনের দান। যেদিন সকালে পড়া থাকত, সেদিন তাঁদের একমাত্র মেয়ের সরোদ বাদন আমায় মুগ্ধ করত (প্র্যাকটিস করত)। সকালটা অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে উঠত। পরে সেও অংকে অনার্স নিয়ে বিশ্বভারতীতে পড়তে গেল। স্যারও খুব ভালো সরোদ বাজাতেন। স্যার আমায় বলেছিলেন "মাস্টার্স করলে শান্তিনিকেতনে করতে পারো। ওখানে আপি আছে, আমাদের বাড়িতে তুমি আপির সঙ্গে থাকতে পারো। কোনও অসুবিধে হবেনা। আমার অনার্সে ৫০% ছিলনা, ফলে বিশ্বভারতীতে আবেদনই করতে পারিনি, কিন্তু স্যারের ওই প্রস্তাব আমার কাছে জীবনের সেরা পুরস্কার হয়ে রয়েছে। স্যার যে আমাকে তাঁর মেয়ের সঙ্গে থাকার উপযুক্ত ভেবেছিলেন, সেই স্বীকৃতি আমার নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।
এবারে একটু কাজের কথা বলি। বিশ্বভারতীই হবে বিশ্বের প্রথম হেরিটেজ বিশ্ববিদ্যালয়। সাধারণত একটি স্মৃতিস্তম্ভকে হেরিটেজ ট্যাগ দেওয়া হয়। বিশ্বে এই প্রথমবার 'লাইভ হেরিটেজ' হিসেবে স্বীকৃতি পেতে চলেছে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮৬৩ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের জমিদার ভুবন মোহন সিংহের কাছ থেকে দুটি ছাতিম গাছসহ ২০ একর জমি ইজারায় কিনেছিলেন। তিনি একটি অতিথিশালা তৈরি করেছিলেন এখানে। নাম রেখেছিল 'শান্তিনিকেতন'। পরবর্তীকালে ১৭ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে আসেন। ১৯০১ সালে রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে একটি ব্রহ্মচর্য আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২১ সালে ১১৩০ একর জমিতে বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯২২ সালের মে মাসে বিশ্বভারতী সোসাইটি একটি সংস্থা হিসেবে নিবন্ধিত না হওয়া পর্যন্ত এটি নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামেই ছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বেশ কিছু সম্পত্তি, জমি এবং একটি বাংলো সেই সময়ে বিশ্বভারতী সোসাইটিকে দান করেছিলেন। স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত এটি একটি কলেজ ছিল এবং ১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দেওয়া হয়। বিশ্বভারতীর প্রথম উপাচার্য হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর আচার্য হলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। দ্বিতীয় উপাচার্য ছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের ঠাকুরদা। প্রধানমন্ত্রী আচার্য হওয়ায় আর্থিক সমস্যার সমাধান অনেক সহজ হয়ে গেল। ১১ অক্টবর ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ লস এঞ্জেলস থেকে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, "শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যোগের সূত্র করে তুলতে হবে, ঐখানে সর্বজাতিক মনুষ্যত্ব চর্চার কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।" রবীন্দ্রনাথ মুক্ত চিন্তার শিক্ষায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি তেমনভাবেই গড়েছিলেন শান্তিনিকেতনকে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে তৎকালীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের অভিমুখ এবং ইউরোপীয় আধুনিকতা থেকে একেবারে ভিন্ন শিক্ষার অভিমুখ শিখিয়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্বভারতীর হেরিটেজ স্বীকৃতির বিষয়টি পরিকল্পনার মধ্যে আনা হয় ২০১০ সালে। ওই বছরেই কবিগুরুর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী ছিল। কিন্তু তখন তা বাস্তবায়িত হয়নি। ২০২১-এর গোড়ায় ফের বিশ্ব-স্বীকৃতির জন্য কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। ২১ এর আগস্ট মাসে বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতন পরিদর্শনে আসে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির একটি প্রতিনিধিদল। তাঁদের মতামতের ভিত্তিতেই ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায় নাম উঠল শান্তিনিকেতনের। প্রায় এক বছর ধরে বিশ্বভারতীর পুরাতত্ত্ব বিভাগের কাজ চলার পর নবরূপে বিশ্বভারতীকে উপস্থাপন করে কর্তৃপক্ষ। সংরক্ষণ ও সংস্কারের পরিকল্পনা প্রয়োগকে প্রতিনিধিদলের সামনে তুলে ধরে ইউনেস্কোর কাছে নিজেদের পরিকল্পনার কথা জানায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তারই ফলশ্রুতি এই সম্মান ও স্বীকৃতি। স্বীকৃতির কারণ হিসেবে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের উদার বিশ্ববোধের আলোয় গড়ে ওঠা স্থাপত্যের কথা বলেছে ইউনেস্কো। উপনিবেশের অনুকরণে না হেঁটে প্রাচ্যের নান্দনিকতারও যা স্মারক।
তবে বিভিন্ন কারনে এই মূহুর্তে বিশ্বভারতী নিজের মর্যাদা হারাচ্ছে। মাঝে মাঝেই শিরোনামে উঠে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিকীকরণের নামে শান্তিনিকেতনের মুক্ত পরিমন্ডলের যে ভাবনা তা ক্ষুন্ন হতে বসেছে। এই বিষয়ে আশা করব বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ সাবধানে এগোবেন। কারন এই মুক্ত অঙ্গনে শিক্ষাদানের যে ভাবনা, মূলতঃ সেই কারণেই বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সারা বিশ্বে এমন একটি স্বীকৃতি আদায় করতে পেরেছে। সেটা বজায় রাখা আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য।