top of page

নিজেদের মধ্যেই মাথা ঠুকে মরছেন কেন

স্বর্ণালী গোস্বামী

দলের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব থাকতেই পারে। তা জনসমক্ষে এলে তো দলেরই ক্ষতি। ভেবে দেখবেন

নতুন বছর চলেই এলো। বছরের শুরুতে আশা করব এই বছরটা যেন ভালো কাটে সকলের। কিন্তু যে বিষয়টা আমাকে শুরুতেই ঝটকা দিল, বলা যায় অবাক করল, তা হল তৃণমূলের স্পোকসপার্সন কুণাল ঘোষের একটি সিদ্ধান্তের, বলা ভালো বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা কিছু বাক্য বিনিময়।

আসলে গত বছর আরজি করে খুন ও ধর্ষণ যে ভাবে সমগ্র বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা। ধিকি ধিকি করে হলেও তার রেশ এখনও চলছে। এবং সামনে আবারও বড়সড় আন্দোলনের পথে যেতে পারেন প্রতিবাদীরা এমনই শোনা যাচ্ছে। আমার মতে শুধু নয়, গোটা বাংলার বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে এটাই স্বাভাবিক। তবে রাজ্যের সরকার চালাচ্ছে, যে দল, তাদের কাছে এমন প্রতিবাদ নিশ্চয়ই সুখকর নয়। সেটাও খুব স্বাভাবিক। প্রতিবাদের ফলে দোষীরা সঠিক শাস্তি পেলে এবং দুর্নীতি প্রমাণ হয়ে গেলে সরকারে আসীন দলের কালো দাগ লাগবে তা বলাই বাহুল্য। সে সব রাজনৈতিক ভাবে মিটিয়ে নেওয়াই বলিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক কৌশল। যে কারণে রাজনীতির পাশাপাশি কূটনীতি শব্দটি সমান্তরাল ভাবে চলে। সে সব ঠিক আছে। কিন্তু তার হাত ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা- নেত্রীরা বিভিন্ন সময়ে যে সমস্ত বক্তব্য পেশ করেছেন, তা কি আদৌ গ্ৰহণযোগ্য?

কুণালবাবু তো নিজের দল বাঁচাতে শুরু থেকেই আলটপকা মন্তব্য করে যাচ্ছিলেন। আমি আমার লেখায় আগেও তা নিয়ে বলেছি। আসলে আমার শুরু থেকেই বক্তব্য ছিল, কুণালবাবু টিপিক্যাল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন। তিনি একজন রাজনৈতিক লোকের মত যা নয় তাই বলবেন কেন? ওনার যথেষ্ট চক্ষুশূল হলেন আমাদের অভিনেতা সাংসদ দীপক অধিকারী বা দেব। আমার একটুও বলতে দ্বিধা নেই, দেবের মুখ দিয়ে কোনও দিন অহেতুক আলটপকা কোনও মন্তব্য শোনা যায়নি, যা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হতে পারে। অথচ তিনি সকলের সঙ্গে মিশে নিজের শিল্পীসত্ত্বা বজায় রেখে দলীয় সাংসদের দায়িত্বও পালন করছেন। এটাই আমি বলতে চাই। একজন সাংবাদিক হয়ে (কুণাল বাবু প্রথমে একজন সাংবাদিক, পরে তৃণমূল স্পোকসপার্সন বলে আমি অন্তত দেখি) একটু বুঝে মন্তব্য করলে তাঁর সাংবাদিক সত্ত্বা অনেকটাই আলোকিত হতে পারত। সংগীত মেলায় তিনি এমন কাউকে এন্ট্রি দিতে চাননা, যাঁরা সরকারের অপমান করেছেন। কিন্তু কেন? সেই শিল্পী তো নিজের বাক-স্বাধীনতাই প্রকাশ করেছেন। একটি হাড় হিম করা ঘটনা এবং তার অন্তরালে ঘটে যাওয়া বীভৎস দুর্নীতির প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজের ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন। এবারে আপনি যদি সেই শিল্পীকে সরকারি মঞ্চে সুযোগ না দেন, তাহলে কী বোঝা গেল? আপনি এবং আপনার দল সেই কটু কথা বলার জন্য সেই শিল্পীকে শাস্তি দিতে চান তো? সেটা কী হীরক রাজার দেশের রাজার মত হয়ে যাচ্ছে বলে আপনার মনে হচ্ছেনা? রাজ্য সরকার দুর্নীতির মোকাবিলা করার চাইতে শাস্তি দেওয়াতেই তো ফোকাস করছে বেশি। যদিও আজকাল সব দলের উদ্দেশ্যও তাই। তাহলে তৃণমূল নিজেকে আলাদা দল, মানুষের জন্য কাজ করার দল হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চেঁচায় কেন?

তৃণমূল কেন্দ্রের থেকে অনুদান নেয়না। কেন নেয়না? শুধুমাত্র কেন্দ্রের বিরোধিতা করে বলে? নাকি কেন্দ্রের অনুদান পেতে যা যা পালনীয় কর্তব্য আছে, সেগুলো করেনা বলে? তার ফলে দলের গোঁয়ার্তুমি বজায় থাকলেও সাফার করছে তো সাধারণ বিশেষ করে সমাজের খেটে খাওয়া মানুষজন। তারা তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। রাজ্য সরকার তো বর্তমানে রাজ্যটাকে নিজের সম্পত্তি হিসেবে পরিগণিত করে ফেলেছে। কেন? গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সেটা কি উচিত? নিজেদের ভুল কোথায়, তা দেখতে হবেনা? কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে শাস্তি পেতে হবে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে অপমানসূচক কথা বলেন না? ভরা জনসভায় যা নয় তাই বলেন না? তার বেলায় দোষ নেই? প্রধানমন্ত্রী নিজে বিভিন্ন নেতা- নেত্রীদের উদ্দেশ্যে অপমানসূচক মন্তব্য করেন না? তার বেলায় দোষ নেই? সাধারণ মানুষ, শিল্পীরা কিছু বললেই দোষ? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিজের সম্মান বজায় রাখতে পারেন? বিভিন্ন জনসভায়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজের ভাষণে আলটপকা কথা বলেন না? আমরা তা জানি না? নিজে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তাঁর সরকারি আধিকারিকদের সর্বসমক্ষে কটুকথা বলেন না? অসম্মান করেন না? কোন অধিকারে তিনি এমনটা করতে পারেন? কই, তখন তো কারো হিম্মত হয় না প্রতিবাদ করে বলার, মুখ্যমন্ত্রী কেন এমন বলবেন? সরকারী কর্মীরা, আমলারা কী মুখ্যমন্ত্রীর মাইনে করা চাকর? তাঁরা রীতিমতো পড়াশোনা করে চাকরির পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন (যারা টাকার পুঁটুলি দিয়ে চাকরি জুটিয়েছেন তাদের কথা আমি বলতে চাইছি না)। সেগুলো দেখুন কুণাল বাবু। ব্রাত্য বসুকে সকলের সামনে সেদিনই ভর্ৎসনা করলেন, প্রাথমিকে সেমেস্টার চালু করার জন্য। উনি তো একা সিদ্ধান্ত নেননি। একটা কমিটি থেকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর ওভাবে বলা উচিত হয়েছে বলে আপনারা মনে করেন? ওনাকে কে শাস্তি দেবে?

তাছাড়া দলের অন্দরে দ্বন্দ্ব তৈরিই বা হল কেন, অভিষেক বলেছেন, প্রতিবাদীরা প্রতিবাদ করতেই পারেন আবার কোনও অনুষ্ঠানের দায়িত্বে যিনি আছেন, তিনি স্বাধীনভাবে তাঁর শিল্পী বাছাই করতেই পারেন। এই নিয়ে তো দ্বন্দ্ব তৈরী হওয়ার কথাই নয়। কুণাল ঘোষ বা আরও এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ব্রাত্য বসুও অব্দি দলের বিশেষ করে নেত্রীর একান্ত অনুগত হিসেবে নিজেদের প্রতিপন্ন করতে মরিয়া হয়ে উঠলেন। আরে সাংবাদিকেরা তো এসবই করবে, খুঁটে খুঁটে ঘাঁটিয়ে দেবার চেষ্টা করবে। আপনারা নিজের জায়গায় ঠিক থাকলে থাকুন না। জনসমক্ষে দলকে হাটখোলা করছেন কেন? শিক্ষিত উচ্চপদে আসীন হয়েই যদি এমন করেন, তাহলে নিচুতলার কর্মীরা শিখবে কী? অভিষেক আরজি কর কাণ্ডের সময় চুপ ছিলেন, ভালো কথা। কিন্তু তিনি কোনও আলটপকা মন্তব্য করেছেন কি, যাতে দলের নিচুতলার কর্মীদের মধ্যে অচলাবস্থার তৈরী হয়? আপনারা কেন করছেন? কুণালবাবু যদি জানেন, তিনি যা বলেছেন, তাতে দলের অন্যান্য সদস্যেরও সায় আছে, তা তো সরকারিভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সকলের মধ্যে তাইনা? দলগত ভাবেতো নয়? তাহলে এর মধ্যে বিতর্ক তৈরী করছেন কেন? অভিষেক বলেছেন, সরকারের তরফে কোনও নোটিস দেওয়া হয়নি। সেটা তো সত্যি। যা হয়েছে, সেই অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা পদাধিকারীদের সিদ্ধান্তের নিরিখে হয়েছে। এর মধ্যে দোষ তো কুণালবাবুর থাকা উচিত নয়? তাহলে সাফাই কেন? ব্রাত্য বসুই বা কেন বললেন, নেত্রী যা বলবেন, সেটাই আমার বক্তব্য! কোনও বক্তব্য নেই, এমনটাও তো বলা যেত। হাসিমুখে বা গম্ভীর মুখে জবাব না দিলেই তো মিটে যায়, কোনও প্রশ্ন ওঠেনা। তাহলেই তো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সাংবাদিকেরা দলের দুই ভাগ সামনে আনতে পারত না! দলের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব থাকতেই পারে। তা জনসমক্ষে এলে তো দলেরই ক্ষতি। ভেবে দেখবেন।

bottom of page