স্বর্ণালী গোস্বামী
যে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ এখনও শিক্ষাকে অবলম্বন করে, নৈতিকতাকে অবলম্বন করে বেঁচে আছেন, তাদের দিকে তাকিয়েই সমাজ ধিকিধিকি করে বেঁচে থাকবে।
কিছু কিছু পেশা থাকে, যা সমাজের সাধারণ মানুষদের পরিষেবা প্রদানের জন্যই গঠিত হয়। কিন্তু এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে প্রতিটি পেশাকে নিজ নিজ স্বার্থে তার সঠিক জায়গা থেকে আমরা কি নির্বিকারভাবে সরিয়ে নিয়ে এসেছি, ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। আসলে সদ্য দগদগে ক্ষতের মতো যা আমাদের প্রতিনিয়ত ভাবাচ্ছে, তা হল করমন্ডল এক্সপ্রেসের ভয়াবহ দুর্ঘটনা। তার পাশাপাশি একটি বেসরকারি ব্যাংকের ইন্টারনাল মিটিংয়ের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যা শুনলে হতচকিত হতে হয়! জানি এই দুয়ের কোনও সম্পর্ক নেই। ভয়াবহতাও এক পংক্তিতে ফেলা যাবেনা। কিন্তু কেন যেন আমার মনে হচ্ছে কোথাও গিয়ে স্বার্থপরতা সম্পৃক্ত হয়ে গেছে এই দুটি ক্ষেত্রে।
আসলে যে পরিবারে বেড়ে উঠেছি, সেই পরিবারটি দাঁড়িয়ে ছিল মূলতঃ রেল এবং ব্যাংককে ঘিরে। তাই এই দুটি সেক্টরের প্রতি আমার দুর্বলতা একটু বেশি। আমার বাবা, জেঠু, পিসেমশাই, আরও দু-তিনজন দূরসম্পর্কের অথচ নিকট আত্মীয় জেঠু, দাদুভাই(মায়ের বাবা) থেকে মামা, মেসোমশাই সকলে রেলের কর্মী। অপরদিকে কাকু, পিসতুতো দুই দাদা স্টেট্ ব্যাংকের কর্মী। ছোট থেকেই দেখে এসেছি, কাজের ব্যাপারে কি পরিমান দায়িত্ববোধ তথা যে কথা শুরুতেই বললাম, পরিষেবা প্রদানের দায়বদ্ধতা নিয়ে এনারা কাজ করেছেন। আর আজ অন্যরকম কিছু দেখে সেই সময়গুলো কিছুতেই মেলাতে পারিনা।
যদিও মূলত লিখতে বসেছি ব্যাংককর্মীর ভাইরাল হওয়া ভিডিও নিয়ে, কিন্তু রেল দুর্ঘটনাটা এড়িয়ে যেতে মন চাইল না। কারন, সিগন্যাল ব্যবস্থার ত্রুটিই হোক বা রেল কর্মচারীর একটু ভুল, ব্যাপারটা তো নিহিত রয়েছে এই চটকদারীতার মধ্যেই। কেন্দ্রের সরকার এত এত ট্রেন উদ্বোধন করছে। ঝাঁ চকচকে তার সব ব্যবস্থা, গতিতে এক একটি ট্রেন এ বলে আমায় দ্যাখ তো আর একটি বলে আমায় দ্যাখ। কিন্তু নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে গুরুত্ব দেওয়ার বালাই নেই সরকারের। এক আধিকারিক দাবি করেছেন, সিগন্যালিং ব্যবস্থায় ত্রুটি রয়েছে, এমনটা তিনি ওপরওয়ালাকে জানিয়েছিলেন, কিন্তু সে বিষয়ে আমল দেওয়া হয়নি। আবার শোনা যাচ্ছে, রেলকর্মীর কোনও ভুল থাকতে পারে, কারন ওই লাইনে প্রচুর ট্রেন চলাচল করে, তুলনায় কর্মীসংখ্যা অনেক কম। কাজের স্ট্রেস তাই স্বাভাবিকভাবেই বেশি। সেক্ষেত্রে ভুল হওয়া দোষের কিছু নয়। মানুষ মাত্রেই ভুল হতে পারে। কিন্তু তার খেসারত দিতে হল শ'য়ে শ'য়ে মানুষকে। এটা তো ঠিক। তাহলে পরিষেবা কোথায়? আলগা চটকদারীতা দিয়ে পরিষেবার গলা টিপে ধরা হচ্ছে। সেটাই তো কাম্য নয়। সাধারণ মানুষ নিশ্চিন্তে এক জায়গা থেকে অপর জায়গায় নিশ্চিন্তে যাবে তার উপায় কোথায়?
আমার বাবার সিগন্যাল নিয়েই কাজ ছিল। ফিল্ডের ডিউটি। কাজের কোনও সময়সীমা ছিলনা। জ্ঞান হয়ে থেকে দেখছি, বাবা চাকরি অন্ত প্রাণ। রুটিন মাফিক সকাল ৭টায় ঘর থেকে বেরিয়ে স্টেশনে অ্যাটেন্ডেন্স দিয়ে কোথায় ডিউটি হবে জেনে বেলা ৯টায় তল্পিতল্পা নিয়ে বেরোতেন বাবা। ফেরার কোনও সময় থাকতনা। কাজ কম থাকলে কোনওদিন ২টোর মধ্যেই বাড়ি ফিরতেন, কোনওদিন সন্ধ্যা ৬টা বেজে যেত। আর ছিল কথায় কথায় মেমো নিয়ে বাড়িতে মেমোবাহকের আগমন। সিগন্যালে কোনও সমস্যা হয়েছে, চলো, ডাক পড়েছে। তখন যে অবস্থাতেই থাকো না কেন, ধড়াচুড়ো পড়ে ছুটতে হবে। বাবার আগে ছিল ইয়ার্ডে কাজ। তখন তেমন এমার্জেন্সি থাকতনা। কিন্তু ১৯৮৫ থেকে বাবার রিটায়ারমেন্ট ২০০২ অব্দি আলুয়াবাড়িতে বাবা চূড়ান্ত একটা ব্যস্ত সময় কাটিয়েছে। একদিকে গাইসল অন্যদিকে তিনমাইলহাট হয়ে ধুমডাঙ্গি। এই ছিল বাবার এরিয়া। এমনও হয়েছে, সন্ধ্যা ৬ টায় বাড়ি এসে ফের ৮টায় বেরোতে হয়েছে। ফিরেছে হয়ত পরদিন সকালে। কোনওদিন রাত ২টোয় মেমো এসেছে। তখনই ছুটতে হয়েছে। তো এগুলো চোখের সামনে দেখা। গাইসাল দুর্ঘটনার সময় আমরা ওখানেই। ভাগ্য ভালো, সেই সপ্তাহে বাবার এদিকটায় অর্থাৎ এনজেপি-র দিকে ডিউটি ছিল, কিষাণগঞ্জের দিকে নয়। সেই সময়ও যথেষ্ট জলঘোলা হয়েছিল ওই দুর্ঘটনা নিয়ে। কিন্তু এখন প্রযুক্তি অনেক উন্নত হয়েছে, এখন এমন দুর্ঘটনা মনকে ভাবায় বৈ কি! আরও কিছু লেখা যেত, কিন্তু তাহলে এই লেখা শেষ হবেনা।
এ তো গেল রেলের ব্যাপার।
ফুলকাকু ছিলেন ব্যাংকে। ফিল্ড অফিসার, ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হিসেবে সেই সময় কাজ করেছেন। সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর মানুষদের কত তাড়াতাড়ি লোন স্যাংশন করে একটা রিক্সা বা জমি চাষের ট্র্যাক্টর কিনে দেওয়া যায়, তার দিকে যথেষ্ট খেয়াল থাকত কাকুর। তেমন কাছ থেকে সবটুকু না জানলেও এটুকু বুঝতাম, মানুষের জন্য করাই ব্যাংকিং সেক্টরের কাজ। কিন্তু ওই ভাইরাল ভিডিওতে কী দেখলাম??? পুষ্পল রায় নামক অত উঁচু পদাধিকারীর ব্যক্তিটি একদিনে এমন পিশাচের মত ব্যবহার করছিল এমনটা নিশ্চয়ই নয়। তার উন্নতির মুলে ওই থ্রেটবাজি। বহুদিন ধরেই সে এমন ব্যবহারই করে আসছে। আজ কেউ বীতশ্রদ্ধ হয়ে মিটিংয়ের ভিডিওটা লিক করে দিয়েছে। ব্যাংক মানুষের জন্য। কিন্তু ঘাড় ধরে সাধারণ মানুষের অ্যাকাউন্ট খোলানোর জন্য কী ব্যাংকিং সেক্টর?
আমি নিজেও এই ব্যাপারে ভুক্তভোগী। আমার নিজের ১৮ বছরের মেয়ের অ্যাকাউন্ট খুলতে গিয়েছিলাম। ব্যাংক তার ডিম্যাট অ্যাকাউন্টও জোর করে খুলিয়ে দিল। বলছে পরে কাজে লাগবে। পরে লাগবে ঠিক আছে, কিন্তু এখনতো লাগবেনা! তাছাড়া আমরা ডিম্যাট অ্যাকাউন্টের পরিষেবা নাই নিতে পারি। হাজারটা কথা খরচ করে সেই অ্যাকাউন্ট সম্বন্ধে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন ওই অফিসার। আমাদের না হয় শেয়ার ইত্যাদি নিয়ে কিছু কাজকারবার আছে, কিন্তু সমাজের সব স্তরে তো তা নেই! জোর করে এমনটা করবে কেন স্টেট্ ব্যংকের অফিসার? বুঝলাম এটাই বর্তমানে প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিতে দস্তুর। গ্রাহকদের পরিষেবা দেওয়ার বদলে ব্যাংকের কত অ্যাকাউন্ট বাড়ল, তার হিসেবে নিকেশেই ব্যাংক এখন বেশি ব্যস্ত।
তার জন্য ভুগতে হয় কর্মীদের। সবসময় তটস্থ থাকতে হয় ওপরওয়ালাকে জবাবদিহি করতে হবে। তার নমুনা হিসেবেই পেলাম ওই ভাইরাল হওয়া ভিডিও। ধোপদুরস্ত পোশাক পরা ব্যাংকারদের এ হেন গালিগালাজ পূর্ণ কথাবার্তা সমাজের শিক্ষিত মানুষদের ন্যূনতম শিক্ষা, শালীনতা তথা নৈতিকবোধের দিকে একটা বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন তুলে দেয়। ওই ব্যাংকার তার পরবর্তী প্রজন্মকে কী শিক্ষা দেবে? কীভাবে পরবর্তী প্রজন্ম যথার্থ শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারবে এমন অভিভাবকদের ছত্রছায়ায়? তারা তো জ্ঞান হয়েই দেখছে কাজ আদায় করতে গেলে নোংরাভাবে কথাবার্তা বলতে হয়। শিক্ষার যে স্থিরতা, তাই তো জানেনা এরা। কথাবার্তায় রুচিবোধ কোথায় এত বড় পদাধিকারী একজন ব্যক্তির?
এই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, তাই আমরা ওই ব্যক্তিকে শাপশাপান্ত করছি। ব্যাংক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে তাকে বহিষ্কার করেছে। বলা হচ্ছে, দু-একজন ব্যক্তির জন্য সবাইকে শুনতে হয়। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি, এটা দু-একজনের ব্যাপার নয়। বরং আজকের দিনে খুঁজলে দু-একজন সত্যিকারের শিক্ষিত মানুষই পাওয়া যাবে আমাদের সমাজে। বাকি বেশিরভাগ এই ধরনের। হয়ত সকলে এতটা কুরুচীকরভাবে কাজ হাসিল করেনা, কিন্তু ধরনটা এমনই। অর্থাৎ কাজ পেতে গেলে ছড়ি ঘোরাতেই হবে, এবং সেটা অবশ্যই অন্যের সম্মানকে কোনওভাবেই গুরুত্ব না দিয়ে। কঠোর অন্যভাবেও হওয়া যায়। কাজে যারা ফাঁকি দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, তাদের কমিশনের পার্সেন্টেজ কমিয়ে দিয়ে বা অন্য কোনও উপায় অবলম্বন করে, যাতে শাস্তিও দেওয়া হল অথচ সরাসরি সম্মানহানিও করার দরকার পড়লনা। কিন্তু এ কোন কালচার, টার্গেট পূরণ করার? প্রশ্নই থেকে গেল। উত্তর কিছু পাওয়া গেলো না, যাবেও না। যে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ এখনও শিক্ষাকে অবলম্বন করে, নৈতিকতাকে অবলম্বন করে বেঁচে আছেন, তাদের দিকে তাকিয়েই সমাজ ধিকিধিকি করে বেঁচে থাকবে।