top of page

দর্শকদের চাহিদা ও চলচ্চিত্র উৎসব

স্বর্ণালী গোস্বামী

শেষ হল ২৯ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব

শেষ হল ২৯ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। ২০১৬ সাল থেকে এই উৎসবে সামিল হচ্ছি। ২০১৬ সাল থেকেই ছবি দেখার চোখটা বদলে যেতে শুরু করেছে আমার। আগেও যত দিন এগিয়েছে, তত নতুনভাবে ছবি চেনার একটা ইচ্ছে অনুভব করেছি আমি। একটু অন্যধারার ছবি দেখতে পছন্দ করতাম। তাতে শান পড়ল চলচ্চিত্র শতবর্ষ ভবনে একটা ছোট কোর্স করার পর। কতটা কী আক্ষরিক অর্থে শিখেছি, সেটা পরের বিষয়, যেটা শিখলাম, তা হল ছবির গল্প ছাড়াও সত্যিই আরও কিছু থাকে, যা দর্শককে ভাবাতে পারে। আর যেটা আমার জীবনে জুড়ে গেল, তা হল নিজে কিছু ভাবনা থেকে মুভিং ইমেজ তৈরী করে ফেলা। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে ২০১৬ সাল আমার জীবনে একটা বড় বদল এনে দিয়েছিল।

আর পেয়েছিলাম ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ডেলিগেট কার্ড পাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। আমার কাছে এই ব্যাপারটা খুব ঈর্ষণীয় ছিল। কলকাতায় আসার পর (২০১০- ২০১৫) একবার/ দুবার হয়তো টিকিট কেটে ছবি দেখেছিলাম উৎসবে। বড্ড বেশি ভিড় হয় বলে খুব যে পছন্দ হয়েছিল গোটা ব্যাপারটা তা নয়। ভাবতাম, ডেলিগেটরা কি সুন্দর চটপট যে কোনও হলে ঢুকে যেতে পারে! তো ২০১৬ সাল আমার সেই সাধ পূরণ করেছিল। প্রথম বছর বেশ ঘটা করে সকাল থেকে গিয়ে রাত অব্দি ছবি দেখেছিলাম মনে আছে। আগে মুষ্টিমেয় সংখ্যক বিদেশী ছবি দেখা আমি সেই প্রথম একসঙ্গে অতগুলো বিদেশী ছবি দেখতে পেয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম তা বলাই বাহুল্য। হলে গিয়ে বিদেশী ছবি দেখা হতনা, বাড়িতেও দেখতে ইচ্ছে করত না। এখনও সেই রকমই আছি যদিও। তাই ফেস্টিভ্যালে গিয়ে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন পরিচালক, তথা অভিনেতা অভিনেত্রীদের ছবি দেখার সুযোগ করে নিয়েছিলাম এই উৎসবেই।

তো এই ছবি দেখতে দেখতে নিজে কিছু করার তাগিদ অনুভব করলাম অচিরেই। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। লেগে পড়লাম ছোট ছোট মুভিং ইমেজ তৈরি করতে। মোবাইলেই ভিডিও করে তা নিজেই এডিট করে একটু একটু করে গড়তে লাগলাম নিজেকে। তারপর ভাবলাম, সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা আছে যখন, তাহলে ডকুমেন্টারি বানালে কেমন হয়? নিজের ফান্ডিং- এ শুরু করলাম প্রথম ডকুমেন্টারি ছবির কাজ (এক্ষেত্রে যদিও শুভজিতকে ধন্যবাদ দিতেই হয়, আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য)। এবং পরে মোবাইলকে সঙ্গী করে শুরু করে দিলাম নিজের ইউটিউব চ্যানেল। সাবস্ক্রাইবার কত হল না হল, তাই নিয়ে মাথা ব্যাথা না করে কাজটা যাতে পাতে দেওয়ার যোগ্য হয়, সেই দিকেই নজর দিয়েছি বেশি।

এবারে আসি মূল প্রসঙ্গে। চলচ্চিত্র উৎসবে এবারে বেশ কয়েকটা ভালো ছবি দেখেছি। ল্যান্ড অফ আওয়ার মাদার্স, পারফেক্ট ডেজ, আ লেটার ফ্রম হেলগা, চালচিত্র এখন, ক্লারা, দ্য ওল্ড ওক, কিডন্যাপড, হেমন্তের অপরাহ্ন, জোসেফস সন, অল দ্যাট ব্রিদস, ক্রিটিক্যাল জোন, দ্য সোয়ালো, ডকুমেন্টারি ফিল্ম- লঙ্গুর এবং চ্যালেঞ্জ। শেষে দেখলাম পুরস্কার প্রাপ্ত চিলড্রেন অফ নোবডি। আমার পারফেক্ট ডেজ, জোসেফস সন, ল্যান্ড অফ আওয়ার মাদার্স, ক্লারা, অল দ্যাট ব্রিদস, চালচিত্র এখন, ডকুমেন্টারি ছবি দুটি খুব ভালো লেগেছে। রিভিউ অবশ্যই লিখব না, তবে পুরস্কার প্রাপ্ত ছবিটিও বেশ ভালো।

আমি আজকে একটা ব্যাপারে আলোকপাত করার জন্য লেখাটা শুরু করেছি। যত দিন যাচ্ছে, চলচ্চিত্র উৎসবে ডেলিগেটদের সংখ্যা বাড়ছে স্বাভাবিকভাবেই। সঙ্গে বাড়ছে গেস্ট কার্ডের রমরমা। এই গেস্ট কার্ড নিয়ে প্রচুর মানুষ ডেলিগেটদের সমান সুবিধা পাচ্ছেন। তাছাড়া রয়েছে ফ্রি পাসের ব্যবস্থা। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, নন্দন- রবীন্দ্র সদন চত্ত্বর কী সাংঘাতিক ভিড়ে ঠাসা থাকছে প্রতিদিন! এর ওপর উইক এন্ডে মনে হয় দূর্গা পুজোর রাত! এবারে ডেলিগেট কার্ড প্রাপকদের সংখ্যা মোটামুটি হাজার পাঁচেক। তা বাদে গেস্ট কার্ডের সংখ্যা কত সে হিসেব আমার কাছে নেই। এই বারে যেটা হচ্ছে, বহু ডেলিগেট কার্ড হোল্ডাররা সিনেমা দেখার লাইনে দাঁড়িয়েও সিনেমা দেখতে পারছেন না। যদিও প্রতি বছরই এটা হয়। হলের তো একটা নির্ধারিত জায়গা রয়েছে, ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু এবারে সমস্যা হয়েছে অন্য জায়গায়। রবিবার ঠাসা নন্দন চত্ত্বর, তাঁর বহু প্রচারিত ছবি 'কেনেডি' নিয়ে স্বয়ং অনুরাগ কাশ্যপ এসেছেন উৎসবে। বলুন তো, কোন মানুষটা এই সুযোগ হাতছাড়া করবে আমার মত চূড়ান্ত কেজো এবং যুক্তি ছাড়া কোনও কাজ না করা আহাম্মক ছাড়া? তো যা হবার, তাই হয়েছে সেদিন রাতের শো-য়ে। সকালে 'চলচ্চিত্র এখন' ছবিটিও প্রচুর মানুষ দেখতে পাননি। তবে তখন তেমন গন্ডগোল হয়নি। কিন্তু রাতের কেসটা ছিল একেবারে আলাদা। রীতিমতো হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গিয়েছিল সেদিন। পুলিশ ডেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়েছে। যে কারনে ওই সিনেমার শো'টি শিরোনামে এসেছে, তা হল, নন্দন ১ এ সেই শো'তে প্রচুর স্বনামধন্য গেস্ট এবং তাদের নিজস্ব আত্মীয়- পরিজনে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল হলের লাউঞ্জ। তার ওপর ছিল সাধারণ ডেলিগেটদের, চোখ বাঁচিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে লাইনে ফেরত না আসার গল্প। কেনেডি দেখতে সেদিন লাইন পড়েছিল বিপুল সংখ্যায়। কিন্তু মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া কেউই সেই ছবি দেখতে পাননি।

পরদিন সিনেমা দেখিতে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষদর্শী এবং ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে যা শুনলাম, তা হল- পুলিশ আসার পর কিছু জন রীতিমত বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে, তারপর অনুরাগ উৎসব কমিটিকে বলেন, সিঁড়িতে বসিয়ে যত বেশি সম্ভব দর্শক হলে নিয়ে নিতে। সেভাবে বেশ কিছু দর্শক অবশেষে ছবিটি দেখতে পায়। আর একজন ডেলিগেট বললেন, আগের শো, দুটি ছবির সমন্বয়ে ছিল, কাজেই অনেকেই একটি দেখে বেরিয়ে অন্যটি দেখতে ঢুকেছেন গেট দিয়ে, কিন্তু ছবি দেখতে না গিয়ে ওয়াশরুমে সময় কাটাচ্ছিলেন। অনেকের সঙ্গে তিনিও ছিলেন সেই দলে। তিনিই বললেন, নন্দনে ওপরে ভিড়ে ঠাসা লোক ছিল গেস্ট এবং তাদের আত্মীয়- পরিজনেরা প্রচুর সংখ্যায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। সেখানে কে অতিথি আর কে 'চোর' (ছবি দেখতে এসে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়া পাবলিক), তা বোঝার সাধ্যি গেটকিপারদের ছিলনা। ফলে তুমুল বাওয়াল হচ্ছিল ওপরে। আর একজন বললেন, তিনি বিকেল ৪টে থেকে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি সহ মোট ২০/২২ জন হলে ঢুকে সিনেমা দেখার বৈধ সিট পেয়েছিলেন সেদিন। অপর আর এক ডেলিগেট বললেন, তিনি লাইন দিয়েছিলেন বিকেল ৫.৩০ টায়। ছবি কিন্তু সন্ধ্যা ৭.০০ টার শো'য়ে ছিল। তিনি ছবি না দেখে ফিরে গিয়েছিলেন। ভাবুন একবার, একটি মানুষ একটি সিনেমা দেখার জন্য সিনেমাকে প্রাধান্য দিয়ে দেড় ঘন্টা আগে লাইনে দাঁড়ালেন। তিনি দেড়টি ঘন্টা অপেক্ষা করে থেকে সিনেমা না দেখে ফিরে গেলেন?

এটা কী কাম্য? কমিটি থেকে বলেছে, বহু চর্চিত ছবি, প্রচুর মানুষ দেখতে এসেছেন, হলে নির্ধারিত সিট, এরকম গন্ডগোল একটু হবে। কিন্তু এত সাধারণ বিষয় ধরে নিলেই কী দায় ঝেড়ে ফেলা যায়? তাহলে আমার প্রশ্ন, আন্তর্জাতিক একটি চলচ্চিত্র উৎসবে এই রকম বহু চর্চিত ছবির স্পেশাল স্ক্রিনিং এমন প্রাইম টাইমে রাখা হল কেন? উদ্যোক্তারা বোঝেননি, তাঁরা কতটা সামাল দিতে পারবেন? কেন মাত্র জনা ২০/২২ জন দর্শক বৈধভাবে ছবি দেখার সুযোগ পাবে? বাকিদের ছবি দেখার সুযোগ করে দেবে কে? কেন উদ্যোক্তাদের অতিথিরা এবং তাদের আত্মীয়- পরিজনেরা ছবি দেখার ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবেন? কেন এতজন দর্শক ছবি না দেখে বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হল? এই এতগুলো কেন'র উত্তর কে দেবে? এতগুলো কেন কিন্তু প্রত্যেক দর্শকদের নিজেদের প্রশ্ন।

এবারে আমি বলি। এমন একটি ছবি উৎসবে আনা অবশ্যই আনন্দের। আনকাট, আনএডিট ছবিটি প্রদর্শিত হয়েছিল। প্রচুর দর্শক মুখিয়ে ছিল ছবিটি দেখার জন্য। ওই চত্ত্বরে মোট পাঁচটা স্ক্রিনিং হল। সাধারণ মানুষ যদি ভিড় হবে ভেবে ৩ ঘন্টা আগে থেকে লাইনে দাঁড়াতে পারে, তাহলে উৎসব উদ্যোক্তারা নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন ভিড় একটা হতে চলেছে, যা রেকর্ড ভিড় হবে! তাঁরা কি চাননা, সকলে ছবি দেখুক? আমার মনে হয় না উদ্যোক্তারা তেমন গুরুত্ব দিয়েছিলেন বিষয়টার প্রতি। প্রত্যেক দর্শকদের সমান গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বিশেষ করে স্পেশাল স্ক্রিনিং যখন করছেন আপনারা। সেই মত সিদ্ধান্ত নিয়ে অন্ততঃ ৩টে হলে (নন্দন-১, নন্দন-২, রবীন্দ্র সদন) ছবিটি দেখানো যেত। বাকি দুটি হলের শিডিউল ছবি শিশির মঞ্চে/ নন্দন-৩ এ এক্সট্রা শো করে দেখিয়ে দেওয়া যেত। অথবা একেবারে ফ্রেশ করে ১টা বা ২টো শো এক্সট্রা করা যেত 'কেনেডি'-র। কোনও আইনক্সেও শো করানো যেতে পারত। স্পেশাল গেস্ট তথা তাঁদের আত্মীয়- পরিজনদের জন্য একেবারে আলাদা শো-য়ের বন্দোবস্ত করা যেত। যদিও বিভিন্ন রকম নিয়মের ব্যাপার থাকে নিশ্চয়ই। সেগুলো বুঝে ছবির ডিমান্ড এবং দর্শকদের দেখতে চাওয়াকে গুরুত্ব দিয়ে কিছু একটা করে যতটা বেশি দর্শকদের দেখানো যেতে পারে তার প্রচেষ্টা যদি উৎসব কমিটি করত, হয়তো অনেক কাছের হয়ে যেত এই উৎসব সাধারণ মানুষের, ঠিক যেমনটা বর্তমানে চাওয়া হচ্ছে চলচ্চিত্র উৎসব সম্পর্কে।

আশা করব ভবিষ্যতে নিজেদের মত করে সিদ্ধান্ত নিয়ে চলচ্চিত্র উৎসব কমিটি এই ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনা যাতে না ঘটে সেই সম্পর্কে সজাগ হবেন এবং সাধারণ মানুষের আরও কাছাকাছি কিভাবে পৌঁছন যায় তার সঠিক প্রচেষ্টা করবেন।


bottom of page