স্বর্ণালী গোস্বামী
জন্মশতবর্ষে মৃণাল সেন-কে আরও বেশি করে জানাই হবে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন
১৪ মে ২০২৩। শতবর্ষে মৃণাল সেন। চলচ্চিত্রকার হিসেবে মৃণাল সেনকে নিয়ে তেমনভাবে কিছু বলতে পারব কি না জানিনা। তবে এটুকু আজ বলতে দ্বিধা নেই, আমি যে জায়গায় বড় হয়েছি, যে পরিবেশে বড় হয়েছি, সেখানে মৃণাল সেনকে নিয়ে ছোটবেলায় বোঝার বা জানার কোনও অবকাশ ছিল না। যদিও সত্যজিৎ রায়কে চিনেছিলাম সোনার কেল্লা, গুপি গাইন- বাঘা বাইন, পথের পাঁচালি দিয়ে, ক্লাস নাইনে। ইসলামপুরের স্টার সিনেমায় সত্যজিতের ছবির প্রদর্শনী হয়েছিল।
এখন ক্লাস নাইনের ছেলে- মেয়েরা অনেককিছু শিখে যায়। তখনও যারা শহুরে বাতাবরনে বড় হয়েছে, তারা হয়ত জানত, কিন্তু আমাদের কাছে সিনেমা/ ফিল্ম ছিল শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম। সেখানে অন্তত মাধ্যমিক পাশ না করলে এন্ট্রি নেওয়ার পারমিট পাওয়া যেত না। নাইন অব্দি দেখা মাত্র দুটি ছবি ছিল আমার ঝুলিতে। সবুজ দ্বীপের রাজা এবং হিন্দির মাসুম। মূলতঃ মধ্যবিত্ত পরিবারের বলা ভালো নিম্ন মধ্যবিত্ত অথচ সংস্কৃতি মনস্ক বাড়িতে সিনেমা নিয়ে আলোচনা বলতে উত্তম-সুচিত্রা ই প্রাধান্য পেত। গান-বাজনা যেমন জ্ঞান হওয়ার আগে থেকেই মননে গেঁথে দেওয়ার প্রয়াস ছিল, ফিল্মের ক্ষেত্রে তেমন ছিলনা। আমাদের বাড়িতে ফিল্ম শিল্পের গুরুত্ব পায়নি, আমাদের ছোটবেলায়। রবীন্দ্র, নজরুল আমাদের জীবনের অংশ ছিলেন কবে থেকে তা আমার নিজেরও মনে নেই। বাড়িতে রোজ নিয়ম করে সকালের আকাশবাণীর অধিবেশন শোনা হত। আমাদের ছোটবেলায় মে মাস ছিল রবীন্দ্র এবং নজরুলের মাস। কিন্তু সত্যজিৎ, মৃণাল সেই জায়গায় ছিলেন না। সত্যজিতের সঙ্গে তারপর পরিচয় শারদীয়ার 'দেশ' - ফেলুদার হাত ধরে। তারপর ফেলুদার আগে প্রকাশিত হয়ে যাওয়া বই কিনে গোগ্রাসে গিলে ফেলা। কিন্তু মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, তপন সিনহা, তরুণ মজুমদার, পরে গৌতম ঘোষ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, অপর্ণা সেন প্রভৃতি পরিচালকের ছবি দেখা হয়েছে কলেজ পাশ করার পর, বাড়িতে টিভি দেখার অফিশিয়াল পারমিশন পাওয়ার পর। ইসলামপুরে ভালো সিনেমা হল ছিলনা। আমরা যখন গিয়েছিলাম ১৯৮৫ সালে, তখন ৪টে হলই ছিল মুলিবাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি। স্টার সিনেমা, মায়া সিনেমা হল, কো অপারেটিভ হল, এবং অপ্সরা হল। স্টার সিনেমা ছিল আমাদের আলুয়াবাড়ি রেলকলোনির গা ঘেঁষে। ধীরে ধীরে অবশ্য ওই সিনেমা হলটিই অন্য সব হলের তুলনায় আধুনিক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ভালো বাংলা ছবি আসত না। তাই সিনেমা হলে গিয়ে কটা সিনেমা দেখেছি, হাতে গুনে বলা যাবে। সিনেমা হলে লেডিস সিট ছিল পর পর কয়েকটা বেঞ্চ পাতা। কাজেই বোঝাই যাচ্ছে, বাইরেও যা, ভেতরেও তথৈবচ। তাই দল বেঁধে সিনেমা যাওয়ার স্মৃতি আমার মনে নেই, শুধুমাত্র কলেজে রায়গঞ্জে দু'বার হস্টেল বান্ধবীদের সঙ্গে সিনেমা দেখা ছাড়া।
যেটা বলছিলাম, তো বিয়ের আগে অব্দি হাতে গোনা টিভিতে দেখা কয়েকটা সিনেমাই ছিল আমার ঝুলিতে। বিয়ের পর শিলিগুড়িতেও তেমন হলে গিয়ে ছবি দেখা হয়নি। পরে সংসার-কাজ নিয়ে ব্যস্ততার চরমে। বলতে দ্বিধা নেই, মৃণাল সেনকে আমি পড়েছি বেশি, দেখেছি কম। তাঁর কাজের প্রতি প্যাশন, তাঁর বোধ, তাঁর ভাবনা, তাঁর দর্শন আমি পড়ে জেনেছি বেশি বিভিন্ন সাক্ষাৎকার এবং গুণী মানুষজনের ভাবনার মাধ্যমে। মৃণাল সেনের কমিউনিস্ট মতাদর্শ তাঁর আদর্শকে তাঁর কাজের প্রতি দায়িত্ববোধকে দৃঢ় করে তুলেছিল, তা বলাই বাহুল্য। তবে যে শুধুমাত্র 'ভুবন সোম' দেখেছে, সে বোধহয় মৃণাল সেনকে অনেকটাই দেখে নিয়েছে এমনটা আমার মনে হয়। এখনও অব্দি সত্যজিৎ যেমন আমার কাছে অনায়াস, মৃণাল ঠিক ততটা নয়।
তবে মৃণাল সেনের জন্ম শতবর্ষে এমন একটি এজেন্ডা নেওয়াই যায়, যা হবে সারা বছর ধরে। ১৪ মে ২০২৩ থেকে ১৪ মে ২০২৪ অব্দি তাঁকে পরিচালক হিসেবে আরও অনেকটা জানার, তাঁর সমস্ত ছবি দেখে ফেলার এজেন্ডা নেওয়াই যায়। আশা করব আগামী বছর তাঁর ছবি নিয়ে কিছু আলোচনা করতে পারব নিজের মত করে।