
স্বর্ণালী গোস্বামী
3 Nov 2025
দীর্ঘ ৭৫ বছর ধরে অপমান সয়ে দাঁতে দাঁত চেপে চলতে চলতে জয়ের স্বাদ উপভোগ করার রাত ছিল গতকাল
বিশ্বজয়ের রাতে ট্রফি নিয়ে ঘুমোলেন হরমনপ্রীত। এই ঘুম শান্তির ঘুম, প্রাপ্তির ঘুম, অধিকার বুঝে নেওয়ার ঘুম, সম্মান কেড়ে নেওয়ার ঘুম, কাজে জবাব দেওয়ার ঘুম, লড়াই করে জিতে নেওয়ার ঘুম। এ ঘুম বড়ই প্রশান্তির। ট্রফি জড়িয়ে পোস্ট করেছেন জেমাইমা এবং স্মৃতি মন্দানাও। এ আনন্দ নিজের, এ আনন্দ সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার। সকলকে সোচ্চারে বলার, এতদিনের জেগে রাত কাটানোর পর এই ঘুম সাফল্যের বিছানায় শুয়ে জেগে ওঠার ভোর। এই ভোর অর্ধেক আকাশ ছিনিয়ে নেওয়ার ভোর। এই ভোর রাত দখলের ভোর। কারন খেলা শেষ হয়েছিল রাত ১২ টার কয়েক মুহূর্ত আগে।
আমি খেলা দেখতে ভালোবাসি। বিয়ের আগে ভারতের কোনও খেলাই মিস করতাম না। শুধু ক্রিকেট নয়, টেনিসও (লন টেনিস) আমার প্রিয় খেলা। ফুটবলের চেয়ে এই দুটি খেলাই আমি দেখতে বেশি ভালোবাসি। কারন ফুটবলে আমার মনে হয় যেন একটি বল নিয়ে মারামারি হচ্ছে। সকলের সঙ্গে এই মত মিলবে না জানি। কারন বাঙালি মানেই ফুটবল পাগল জাতি। বস্তুত আমার বাবাও ওপার বাংলার এক সময়ের দাপুটে একজন ফুটবল প্লেয়ার। কিন্তু আমার ভালো লাগে মূলত ক্রিকেট এবং টেনিস। তবে খেলা দেখা নেশার মত। দেখতে শুরু করলে উঠতে ইচ্ছে করেনা। যদিও আমি খেলার সাপোর্টের চেয়ে দেশের সাপোর্টেই খেলা দেখতাম। দেশ হেরে যাবে বুঝতে পারলে টিভি অফ করে দিতাম। কিন্তু ওই, খেলা দেখতে বসলে আর হাড্ডাহাড্ডি খেলা হলে স্ক্রিন থেকে চোখ সরত না। টেনিসে যদিও দেশের ব্যাপার ছিল না। কিন্তু নেশাটা ছিল, উপরি পাওনা টেনশনের ব্যাপার থাকত না। কিন্তু বিয়ের পর আস্তে আস্তে দায়িত্ব বাড়তে শুরু করল। আর খেলা দেখাও কমিয়ে দিলাম। এখন তো বসে কোনদিন শেষ খেলা দেখেছি মনে করে বলতে হয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ খেলা হলে খবর রাখি।
গতকালও তাই হল। দুপুর দুটোয় বাড়িতে টিভি অন হয়ে গিয়েছিল। চলছিল টানা। ভারতের ব্যাটিং-এর সময় পুরোটাই টিভি চলেছে। পরে রাত হয়ে যাওয়ায় এবং পরের দিন ভোরে উঠতে হবে, তাই সেকেন্ড হাফে আর টিভি খোলা হয়নি। কিন্তু আমি লাইভ স্কোরের দিকে নজর রেখেছি। মেয়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেছি আর স্কোর দেখেছি। তবে খেলা দেখছিলাম না। সাড়ে এগারোটায় শুয়ে পড়লাম, ঘুম আসেনা। ৩ নভেম্বর মেয়ের জন্মদিন, ভাবলাম ওদের ওখানে বারোটা পরে বাজবে তো কি? আমাদের এখানে তো আগেই বারোটা বেজে যাবে। মেয়েটাকে উইশ করব তখন। আর খেলার স্কোরটাও দেখতে পারব। আধঘন্টা উশখুশ করে কেটে গেল। দু- তিন মিনিট অন্তর ফোন খুলছি। শুরুতেই খুব তাড়াতাড়ি উইকেট পড়ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার। তবে উলভার্টকে থামানো যাচ্ছিল না। অনেকক্ষন উইকেটও পড়েনি। হঠাৎ দেখলাম ৫ টা উইকেট পড়ে গেছে। তারপর মনে মনে বলছিলাম উইকেট নিতে হবে গার্লস! শতরান করলেন উলভার্ট। এই উইকেটটা তো পড়ছেই না। আবার ফোন খুলে দেখলাম উইকেট পড়ে গেছে। ৮ উইকেট পড়ে গেছে। বাইরে বাজি ফাটছিল আর আমি ফোন খুলছিলাম। তারপর কিছুক্ষন আবার ফোন বন্ধ। শুনছি প্রচুর বাজির আওয়াজ। এদিকে ঘড়িতে বারোটা বাজে। ভাবলাম মেয়েকে উইশ করতে হবে। ওর ডিনার বানাতে যাওয়ারও সময় হয়ে গেছে। দেখি কি করছে। মেসেজ করার আগে স্কোর চেক করতে গিয়ে দেখি ইন্ডিয়া উইন্স ওয়ার্ল্ড কাপ! আনন্দ যেন আর ধরেনা। মেয়েকে মেসেজ করলাম, বার্থডে উইশ করলাম, জানালাম ভারত ইউমেন্স ওয়ার্ল্ড কাপ জিতল। ঘরের দরজা খুলে টিভি অন করে দিলাম। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে কি শুয়ে থাকা যায়! আহা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার মত একটি রাত। রাত দখলের রাত। মেয়েদের জবাব দেবার রাত। উল্লাস করার রাত। জয়ের মুহূর্ত অবিশ্বাস করার রাত।
দীর্ঘ ৭৫ বছর ধরে অপমান সয়ে দাঁতে দাঁত চেপে চলতে চলতে জয়ের স্বাদ উপভোগ করার রাত। যে মহিলারা জেনারেল কম্পার্টমেন্টে টয়লেটের সামনের মেঝেতে বসে এক সময় খেলার জন্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় খেলতে গেছে, সেই বাঁয়ে এলিয়ে রাখা মহিলাদের ছেলেদের পাশে বসে নিজেদের আসন অর্জন করে নেবার রাত। বস্তুত তাঁরা যে পারিশ্রমিকটা পাবেন, তা গত ওয়ার্ল্ড কাপে ছেলেরা যা পেয়েছিল, তার চাইতে বেশি। প্রায় ৪০ কোটি টাকা পাবেন এই বিশ্বকাপ জয়ী মহিলা টিম। এই রাত আমার জীবদ্দশায় আমি তো ভুলবনা। একা একা টিভির সামনে বসে সেলিব্রেশন উপভোগ করছিলাম আমি হাত মুষ্টিবদ্ধ করে। আমার বিশ্বাস বহু বহু মেয়েরা, মহিলারা এটা অনুভব করেছেন। বহু মহিলারা কাল রীতিমত রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন। কাঁদছিলেন, চিৎকার করছিলেন, সাবাশি দিচ্ছিলেন, আশীর্বাদ দিচ্ছিলেন।
রবিবার ছিল গতকাল। আমার রবিবারের আড্ডা লেখার দিন। তবে কাল পাশাপাশি আরও একটা উল্লেখনীয় খবর ছিল। ইসরো 'বাহুবলি' উৎক্ষেপণ করল সফলভাবে। ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে বিশেষ করে সামরিক নজরদারিতে কাজে লাগানো হবে সিএমএস -০৩ উপগ্রহটিকে। করলাম খবর। লিখলাম না আড্ডার লেখা। ভাবলাম আজ তো আড্ডা জমিয়ে রাখার দিন। ভারত জিতলে আগামীকাল আড্ডা হবে জমিয়ে। তাই কাল দম ধরে রেখে উদযাপন করলাম তারিয়ে তারিয়ে। সকলেই তাই করেছে। আজ সারা দেশ জুড়ে ছিল আড্ডার মেজাজ। কাজে কতজন মন বসাতে পেরেছে আমার সন্দেহ। তাই সোমবার হলেও আজই আড্ডার দিন। টেবিল চাপড়ানোর দিন। আমিও তাই রোববারের আড্ডার পেজে সোমবার লেখা আপলোড করছি। মাঝে মাঝে একটু অন্য নিয়ম চলতা হ্যায়। একটু উদযাপনের জন্য মাঝে মাঝে নিয়ম বদল ভালোই, তাই না?



