স্বর্ণালী গোস্বামী
বদলে যাচ্ছে আমার বাংলা ভাষাও, সে তো এখন খিচুড়ি ভাষা!
দু'দিন বাদেই ২১শে ফেব্রুয়ারি। এবারে কেন জানি সেই আমেজটা পাচ্ছিনা। কেমন যেন এই বাংলা ভাষার ঐতিহ্য বিষয়টা আমায় তেমন সাড়া জাগাচ্ছে না। বাংলাতেই তো আছি। চারপাশে বাংলা ভাষাভাষীর লোকজনের কীর্তিকলাপ দেখছি, শুনছি। কি হল বলুন তো, আমাদের এই সাধের রাজ্যটার? চারপাশটা খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। চাকরি নেই, শিক্ষা নেই, রুচি নেই, সংস্কৃতি নেই, সংস্কার নেই, ভদ্রতা নেই, সততা নেই, ভব্যতা নেই, মুখের আগল নেই, সম্মান করার স্পৃহা নেই, মর্যাদাবোধ নেই, কিছুই যেন নেই। এই নেই-এর সমাহারের মধ্যে ভাষা নিয়ে একটি দিবস পালন কেমন যেন নিষ্ফল রোদন বলে মনে হচ্ছে আমার।
বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে চারপাশে তো শুধুই সন্দেশখালি আর লোকসভা নির্বাচন। এই দুইয়ের মধ্যেই যেন ঘুরপাক খাচ্ছে বাঙালি জাতি। চলছে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। সদ্য শেষ হল মাধ্যমিক পরীক্ষা। বাংলা মাধ্যমের পড়ুয়ারাই বেশিরভাগ সংখ্যক এই পরীক্ষাদুটোয় বসে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী পাশ করে বেরোয়। শিক্ষা দফতরের নিয়ম অনুযায়ী কাউকে ফেল করানো যাবেনা, ন্যূনতম উত্তর করলেই। খাতায় কলমে শিক্ষিত তো হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ, কিন্তু আদৌ তার শেকড় বলে কি কিছু থাকছে? পচন ধরা শেকড়ে একটি গাছ কীভাবে বেড়ে উঠবে বলুন তো? চারপাশে এত বিভিন্ন রকম কেলেঙ্কারির মুকুট মাথায় করে জেলের ঘানি টানছেন রাজ্যের তাবড় নেতারা। সমাজের নিচুতলার মানুষেরা সামান্য চুরি করলেই আমরা রে রে করে তেড়ে আসি। আমি একটি কাজে গিয়ে রাত ১০.০০ টায় হাওড়া স্টেশনে নেমে প্রিপেইড ট্যাক্সির(যাত্রী সাথী অ্যাপ চালু হবার আগে) বিরাট লাইন দেখে বাইরে থেকে প্রাইভেট ট্যাক্সি ভাড়ায় রাজি হলাম, একা রিজার্ভ করে যাবো বলে। ট্যাক্সিতে উঠে দেখি সেখানে আগে থেকেই আর একজন সওয়ারি বসে রয়েছেন, যাবার জন্য। আমরা দু'জনেই থ। কারন তিনিও জানতেন না, ড্রাইভার আর একটি মুরগি ধরতে গেছে। রাত হয়েছে, কি আর করা- গাঁই গুঁই করে মৃদু ভর্ৎসনা করে চড়ে বসলাম। কিছুক্ষন পরে আমি বললাম, এমনটা করলে কেন? এটা তো জোচ্চুরির সমান। এক কথা বলে নিয়ে এলে, আর একটা কাজ করলে! আমায় সে বলল, "গরিব মানুষ দিদি, নেতারাই সব টাকা খেয়ে জেলে বসে আছে, আমাদের এটুকুতেই আপনারা বলেন, রাত হলেই একটু রোজগারের আশায় থাকি। আপনারা দুজনেই তো বেহালা যাবেন, সেভাবেই নিয়েছি"। কি বলব তার উত্তরে ভেবে পেলাম না। জাস্ট চুপ করে গেলাম। শুধু বললাম, খারাপ জিনিস শিখতে নেই। কথাবার্তা তো মাতৃভাষাতেই হচ্ছিল!
তবে এটুকু হয়ত আশ্বাস রাখা যায়, সমাজের নিচুতলার মানুষেরা যারা ইংরেজি বলতে পারেনা এবং রাজনীতির মধ্যে সরাসরি যুক্ত নেই তাদের মধ্যে এখনও ছিঁটেফোঁটা হলেও মনুষ্যত্ব রয়েছে। তাও যেভাবে দুর্নীতি আমাদের নাগপাশ করে রেখেছে, কতদিন সেই মায়াজাল কাটিয়ে তারা থাকতে পারবে, তা নিয়ে বড় সন্দেহ হয়। আর একটা ব্যাপার না বললেই নয়, সন্দেশখালি নিয়ে এত কান্ড, সাংসদ নুসরত জাহান সেখানে যাচ্ছেন না, প্রশাসন কাজ করছে বলে তিনি ডিস্টার্ব করতে চাইছেন না বলছেন, কিন্তু নিজে যে সমস্ত ছবি পোস্ট করছেন, তাতে কি একজন বিবেকবান সাংসদের ভূমিকা তিনি পালন করছেন? কেন সাংসদ, আপনি অভিনেত্রী বলে কী আপনার বিবেক থাকতে নেই? একজন মানুষের রুচি এমন কেন হবে? তিনি সেখানকার মানুষদের কিছু বার্তাও তো দিতে পারতেন, অভয় দিতে পারতেন! তিনিও তো বাংলা ভাষাতেই কথা বলেন! তবে হ্যাঁ, ইংরিজিতে অবশ্যই সড়গড়।
বদলে যাচ্ছে দিন দিন আমার রাজ্য, বদলে যাচ্ছি আমরা, বদলে যাচ্ছে আমার মাতৃভাষায় কথা বলা মানুষেরা, বদলে যাচ্ছে সমাজ, এমনকি, বদলে যাচ্ছে আমার বাংলা ভাষাও, সে তো এখন খিচুড়ি ভাষা! বাংলা, হিন্দি, ইংরিজি মিশিয়ে কথা বলা এক জগাখিচুড়ি নব্য প্রজন্ম ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে।
তবে যেতে যেতে বলব, যেমনই হোক ভাষার মাহাত্ম যেন বজায় থাকে, যাঁরা রয়েছেন সমাজে বাংলা ভাষার ধারক এবং বাহক হিসেবে, তাঁরা তাঁদের চেষ্টা চালিয়ে যান, যদি কিছু অলৌকিক ঘটাতে পারেন, তাহলেই এই দুর্দিনে আমাদের মাতৃভাষাকে আন্তর্জাতিকতার স্বীকৃতি দেওয়া যাবে। যাঁরা বিদেশে রয়েছেন, তাঁরা কিন্তু অভিভাবক হিসেবে আমাদের রাজ্যের অভিভাবকদের তুলনায় অনেকটা গুরুত্ব দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে বাংলায় মুড়ে রাখতে চাইছেন, বিদেশী চালচলনের মধ্যে। কাজেই এটাও কম কিছু নয়।