স্বাধীনতার জন্মদিনে আমাদের একটু বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন
কলকাতা, ১৫ অগাস্ট: স্বাধীনতার অর্থ কী? কিছু বছর থেকে স্বাধীনতা এলেই এই প্রশ্ন বোধহয় বেশিরভাগ ভারতবাসীর মনেই উঁকি দেয়, আমরা আদৌ কতটা স্বাধীন হয়েছি? যদিও কিছু মানুষ এমনও আছেন, যাঁদের কাছে স্বাধীনতা দিবস মানেই নাচ- গান- ফুর্তি করার দিন। সেকথায় যাচ্ছিনা। স্বাধীন দেশে কী আমরা সাধারণ মানুষ আদৌ স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে পারি? একটু ভেবে দেখলেই দেখব, আমাদের যে মৌলিক অধিকারগুলি রয়েছে, সেগুলো কী আমরা ঠিকঠাক উপলব্ধ করতে পারি? আমরা কী সবাই আমাদের প্রয়োজনমতো শিক্ষার অধিকার পাচ্ছি? সবাই কী স্বাস্থ্যের অধিকার পাচ্ছি? সবাই বাক- স্বাধীনতা পাচ্ছি? সবাই কী বাসস্থানের অধিকার পাচ্ছি? সবাই কী সঠিক পেশা নির্বাচন করে উপার্জন করার অধিকার পাচ্ছি? সর্বোপরি নিজের সম্মান নিয়ে বাঁচার অধিকার কী আমরা পাচ্ছি? যদিও গর্বের বিষয় যে, আজ ৭৫ বছর অব্দি কোনও বিদেশি শক্তি আমাদের শাসন করতে পারেনি। অন্তত শারীরিক ভাবে হাজির থেকে করেনি। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হল, দেশের মধ্যেই কিছু শক্তি রয়েছে যারা জনসাধারণের মতামতকে তোয়াক্কা করে না। রাজনৈতিক এক নয়া সমীকরণের ঠেলায় আমদের মত সাধারণ মানুষদের নাভিশ্বাস উঠছে। নয়া উদারনীতির চলনে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। সবকিছুতেই বর্তমান রাজনীতির চলন বা ধরণ এখন তার উদ্দেশ্য পালটে ফেলেছে। সবাই খেতে পেল কি পেল না, সবাই পরতে পারল কি পারল না অথবা আমাদের প্রাথমিক যে চাহিদাগুলি খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের সঙ্গে শিক্ষা-স্বাস্থ্য, একটু সামাজিক নিরাপত্তা, এগুলির দিক থেকে আমাদের নজরটা পুরোপুরি সরে গিয়েছে।
আসলে দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রথম ৩০- ৪০ বছর আমাদের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নজর ছিল দেশের সার্বিক উন্নয়ন করা, সাধারণ মানুষকে এক অনন্য স্তরে উন্নীত করা। কিন্তু তারপর থেকে ওটা অন্য বিষয়ের দিকে সরে যায়। ধর্ম-বর্ণ-জাতির মতো বিষয়গুলি তখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তাদের কাছে। এরই ভিত্তিতে রাজনীতির কারবারিরা শ্রেণি বিন্যাসে নেমে পড়েছেন নিজেদের স্বার্থ করায়ত্ত্ব করতে। কিছু অন্ধ অনুসরণকারীরা মেতে উঠেছে সেই অভিমুখে, আর তার মধ্যে যাঁতাকলে পড়ে আমাদের মত সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত পিষে চলেছেন দৈনন্দিন জীবন। প্রাথমিকস্তরে সঠিক শিক্ষার অভাব, শিক্ষা ব্যবস্থাই দুর্নীতির মধ্যে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়েছে। সেখান থেকে বেরোতে যে কত প্রজন্ম বলি প্রদত্ত হবে, তার ইয়ত্তা নেই। উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রেও রয়েছে নৈরাজ্য। রয়েছে টাকা দিয়ে কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের সিট কিনে নেওয়ার মত ব্যাপার। প্রকৃত মেধা সম্পন্ন অথচ নিম্নবিত্ত পরিবারের পড়ুয়ারা তার ফলে সুযোগ হারাচ্ছে। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষান্তে উপযুক্ত চাকরি পাচ্ছেনা। দিনে দিনে দেশে বেকারির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। প্রচুর মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। মুখে দেবার অন্ন নেই। স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও রয়েছে চূড়ান্ত অব্যবস্থার নজির। তবু এ কথা তো অস্বীকার করলে চলবে না, বহু ত্যাগ ও প্রাণের বিনিময়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট মুক্তির স্বাদ পেয়েছিল দেশ। বড় সাধের সেই স্বাধীনতা ৷ গর্বের, আবেগের, দেশের কোটি কোটি নাগরিকের পরিচয়ের সেই স্বাধীনতা নানা পথ পেরিয়ে ৭৫ বছর অতিক্রম করছে। ভারত বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র। গণতন্ত্র হচ্ছে একটি সামগ্রিক ধারণার বিষয়। এর প্রধান তিনটি বৈশিষ্ট্য হিসেবে রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক সাম্যের কথা উল্লেখ করা যায়। এই তিনটি বৈশিষ্ট্য একত্রিত হলে একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্ম দিতে পারে। সেই গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করছে উল্লিখিত সমতার বৈশিষ্ট্য তিনটি সেখানে কতটা গুরুত্ব পায় এবং সেগুলোর বাস্তবায়নই বা কতটা হয় তার ওপর। সেখানেও প্রশ্ন ওঠার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে, আশা করব আমাদের দেশের ঐতিহ্য গণতান্ত্রিক কাঠামোর প্রতি আমরা বিশ্বস্ত থাকব। এটাও সত্য, স্বাধীনতার পরবর্তী এই দীর্ঘ সময়ে আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বের সমাদর পেয়েছি। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে, সামরিক ক্ষেত্রে, ক্রীড়াক্ষেত্রে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে আমাদের। সারা দেশে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ অঞ্চলের উন্নতির পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা হচ্ছে। মহাকাশ বিজ্ঞানে আমাদের উন্নতি চোখে পড়ার মত।
এভাবেই দেশ এগিয়ে যাবে তাই চাই আমরা। কিন্তু তার মধ্যে যে বিরাট খামতি থেকে যাচ্ছে, সেই বিষয়েও দৃষ্টিনিক্ষেপ করা প্রয়োজন।
স্বর্ণালী গোস্বামী
Comments