'থার্ড বেল' ও একটি পরিবারের পূর্ণ বৃত্ত
'থার্ড বেল'- শব্দটির মধ্যে, বলা যায় কথাটির মধ্যে একটা আবেগ আছে। এক এক দিন, এক একটি মুহূর্ত তৈরী হয়ে যায় এই শব্দটির পর থেকে। তবে মঞ্চে যাঁরা দাপিয়ে বেড়ান, তাঁদেরই আবেগটা বেশি কাজ করে তা বলাই বাহুল্য। একটা উত্তেজনাও যে কাজ করেনা, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে সেই উত্তেজনা যাঁরা আত্মস্থ করতে পারেন, তাঁদের দ্বারাই কেল্লা ফতে হয়। নচেৎ শুধুই মঞ্চে ওঠা-নামাই সার হয়। তবে দর্শকাসনে বসে সেই উত্তেজনা অনুভব না করলেও উৎসাহ যে চরমে থাকে, তা নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলতে পারি। সে কথায় গিয়ে কাজ নেই। আসল ব্যাপার হল ওই 'থার্ড বেল'।
থিয়েটার মানুষকে জীবন গঠনে এক বিরাট ভূমিকা নিতে সহায়তা করে। পুঁথিগত বিদ্যায় আমার মতে জীবনের পাঠ সম্পূর্ণ হয়না, যতক্ষন না থিয়েটারের আশ্রয়ে যেতে পারে মানুষ। শিক্ষা, রুজি রোজগার বড্ড কেঠো হয়ে যায় যদি না আমার জীবনের পাঠ নেওয়া থাকে। আমার ধারণা আজকের এই চরম ব্যস্ততার যুগে ডিপ্রেশন, স্ট্রেস নিমেষে কাটানো যায় যদি আমরা সত্যিকারের থিয়েটারের পাঠ নিতে পারি। তবে সেই বিদ্যেটা হতে হবে থিয়েটারকে আত্মস্থ করা। থিয়েটার শেখায় ধৈর্য্য, থিয়েটার শেখায় নিয়মানুবর্তিতা, থিয়েটার শেখায় কর্মনিষ্ঠা, থিয়েটার শেখায় সমস্ত রকম কাজ করার দক্ষতা, থিয়েটার শেখায় মানুষকে ভালোবাসার শিক্ষা, থিয়েটার শেখায় সব কিছু চুটকিতে সমাধান করে ফেলার ক্ষমতা।
তবে থিয়েটারে কিছুটা রিস্কও রয়েছে। অ্যামেচার থিয়েটার করতে গেলে তা নেশায় পরিণত হয়ে যায়। তখন না থাকে সংসারের দায়িত্ব, না থাকে আর্থিক দায়। বর্তমান জেট গতি তথা প্রতিযোগিতার বাজারে এমন মানুষ চোখে না পড়লেও নিজেদের পরিবারে এমন মানুষের গল্প শুনেছি আমি। আজ সেই নিয়েই একটু আলোচনা করব।
বিহারের এক অখ্যাত জায়গা মনিহারি (যদিও সাহিত্যিক বনফুলের নিজের স্থান হিসেবে তা পরিচিত) তে ৬০/৭০ এর দশকে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন আমার দাদামশাই উমাপদ ব্যানার্জী (হারান নামেই অধিক পরিচিত), তাঁর দক্ষ নাট্যব্যক্তিত্ব নিয়ে। কলকাতার সংস্কৃতির সঙ্গে তৎকালীন সময়ে সরাসরি যোগাযোগ ছিল বলে সেই সংস্কৃতির ধারক হয়েছিলেন তিনি মনিহারিতে। নাটক পরিচালনা, প্রযোজনা তথা অভিনয় সব দিকেই সমান পারদর্শী ছিলেন। কিন্তু তৎকালীন সময়ে রেলওয়ে কোম্পানিতে চাকরি করা সত্ত্বেও সংসার দাঁড় করতে পারেননি। ফলে সমাজে যথেষ্ট সুনাম থাকা সত্ত্বেও সংসারে আর্থিক অসচ্ছলতা ধীরে ধীরে তাঁর সুনাম ম্লান করে দিচ্ছিল। তার আরও একটা কারন হয়ত ছিল। হয়ত অখ্যাত জায়গা বলে তাঁর থিয়েটার নিবেদিত প্রাণের কদর করতে পারেনি সেই তখনকার সমাজ। কারন স্বরূপ স্বার্থান্বেষী সমাজেও তিনি তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। অর্থ দিয়ে, শ্রম দিয়ে, কায়মনোবাক্যে যে থিয়েটারে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন, সেই থিয়েটার তাঁকে কিছু ফেরত দেয়নি। তবে যা দিয়েছিল, তা হল একটি দৃঢ় অনমনীয় পরিবার। আমার মা যেহেতু বাড়ির সবচেয়ে বড় ছিলেন, কাজেই তিনিই দেখেছিলেন সবটা। তিনি নিজেও বিয়ের আগে ছিলেন একজন মঞ্চ অভিনেত্রী (শুধুমাত্র দাদুর পরিচালনা, প্রযোজনা করা নাটকেই মায়ের অভিনয় করার অনুমতি ছিল)। দাদুর দুঃসময়ে মা এবং দিদা কঠিন হাতে সংসার সামলেছিলেন।
তবে সেই যে থিয়েটারের পাঠ, তা কিন্তু প্রজন্মের হাত ধরে নিঃশব্দে এসে গিয়েছিল আমাদের মধ্যে। মা সচেতনভাবেই আমাদের থিয়েটারমুখো হতে দেয়নি। তবে নিয়মানুবর্তিতা, দায়িত্বপরায়ণতা, সকলকে সমান চোখে দেখার শিক্ষা, নমনীয় মনোভাব পেয়েছি মায়ের কাছ থেকেই। জীবনের যে কোনও কঠিন সময়ে মনকে শক্ত রেখে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও পেয়েছি মায়ের কাছ থেকে। পেয়েছি ভালোকে ভালো, মন্দকে মন্দ বলার সৎ সাহস। থিয়েটারের প্রতি ভালোবাসা জন্মেছিল মায়ের কাছে গল্প শুনেই। একটা অমোঘ টান অনুভব করতাম অভিনয়ের। তবে মায়ের অবাধ্য হওয়ার প্রবণতা জাগেনি কোনওদিন। কাজেই অভিনয় করা হয়ে ওঠেনি মঞ্চে।
আমাদের বেড়ে ওঠার শহর ইসলামপুরেও (উত্তর দিনাজপুর) কিন্তু নাট্যচর্চা ছিল। পরে শিলিগুড়িতে এলাম। সেখানে বেশ কিছু ঐতিহ্যমন্ডিত নাট্যদল রয়েছে। নিজের সন্তান হওয়ার পর মনের বাসনা ছিল থিয়েটার শেখাব। তবে শিলিগুড়িতে কতটা তা বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়ে সংশয়ে থাকতাম। কিন্তু কাজের সূত্রে যখন সপরিবারে কলকাতায় এলাম, তখন আমার কাছে থিয়েটারের এক বিরাট জগৎ উন্মোচিত হয়ে গেল। কালবিলম্ব না করে মেয়েকে নিয়ে গেলাম নান্দীকার-এ। সেখানে ছোটদের যে ওয়ার্কশপ হয়, তাতে ভর্তি করে দিলাম। মা আজ আর নেই। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল পরিবারের একটা বৃত্ত বোধহয় পূর্ণ হল।
- স্বর্ণালী গোস্বামী
Comentarios