কলকাতা প্রেস ক্লাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ক সভা
কলকাতা, ২০ সেপ্টেম্বর: মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের(মাসুম) পক্ষ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর দুপুর ২টো থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত কলকাতা প্রেস ক্লাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে একটি সভার আয়োজন করা হয়েছিল। এই সভায় 'মাসুম' এর পক্ষ থেকে কিরিটি রায় প্রস্তাব পেশ করেন। প্রস্তাবে বলা হয়-
"আমরা বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) পক্ষ থেকে ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (NHRC) দ্বারা আয়োজিত, আগামি ২০ এবং ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে নয়াদিল্লিতে হতে চলা এশিয়া প্যাসিফিক ফোরামের (APF) ২৮তম দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের তীব্র নিন্দা জানাই। সম্প্রতি ২০২৩ সালের মার্চ মাসে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স অফ ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস ইনস্টিটিউশনস (GANHRI)-এর সাব কমিটি অফ অ্যাক্রেডিটেশন (SCA) দ্বারা ভারতীয় NHRC-র স্বীকৃতি স্থগিত রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ২০২৩ সালের মার্চের পরে NHRC দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নের স্বার্থে যথাযথ কৌশল তৈরি করার জন্য সুশীল সমাজের সদস্যদের সাথে একটি বৈঠকের আহ্বান জানানোরও সাহস পায়নি। পরিবর্তে APF সম্মেলনকে ইস্যুটিকে রাজনীতিকরণ করতে ব্যবহার করেছে।
এটি গভীরভাবে উদ্বেগজনক কারণ NHRC দ্বারা এই মর্যাদাপূর্ণ সম্মেলনের আয়োজন করা ভারতে মানবাধিকার সুরক্ষার গুরুত্বপূর্ণ কারণকে সহায়তা করবে না তবে কেবল তার হতাশাজনক কার্যকারিতা ঢাকতে NHRC-কে আন্তর্জাতিক বৈধতার একটি স্বীকৃতি সরবরাহ করবে। এটি আরও হতাশাজনক কারণ NHRC শুধুমাত্র ভারতে নয় বরং বিশ্ব দরবারে একটি মডেল হিসাবে কাজ করা উচিত ছিল।
গত কয়েক বছরে আমরা তাদের কাছে যে একাধিক অভিযোগ পাঠিয়েছি সে বিষয়ে NHRC নীরব রয়েছে। আমরা গত ২৫ বছর ধরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় কাজ করছি। এই সময়ের মধ্যে, আমরা সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী এবং অন্যান্য রাজ্য কর্তৃপক্ষের দ্বারা এই অঞ্চলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। আমরা NHRC এর কাছে অভিযোগ আকারে ঘটনাগুলি পাঠিয়েছি নমুনা হিসেবে, তারা অপরাধীদের দেওয়া বক্তব্যের ভিত্তিতে বেশিরভাগ মামলার বিচার করেছে বা মামলাটিকে বিচারাধীন বিষয় বলে খারিজ করেছে। NHRC এর উদ্দেশ্য দেশের নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষা করা, পরিবর্তে তারা শুধুমাত্র অপরাধীদের রক্ষা করছে। এটা সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে হাস্যকর পদসেবা ছাড়া আর কিছুই নয়। ১৯৯৩ সালের মানবাধিকার সুরক্ষা আইনের ১২ ধারা অনুসারে, NHRC-র কাছে মানবাধিকার লঙ্ঘন বা সরকারি কর্মচারীর এই ধরনের লঙ্ঘন প্রতিরোধে অবহেলা সম্পর্কিত যে কোনও অভিযোগ তদন্ত করার ক্ষমতা রয়েছে; হয় সুও-মোটো বা পিটিশন পাওয়ার পর। মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেকোনো অভিযোগে তারা বিচারিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু, আমাদের অভিজ্ঞতায় NHRC এই ধারাটিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে।
আমরা এমন একটি এলাকায় কাজ করি, যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অনেক বেশি। আমরা বিভিন্ন মামলার সম্মুখীন হই যেমন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে নির্যাতন, জোরপূর্বক গুমখুন, ধর্ষণ, জীবিকা লঙ্ঘন ইত্যাদি। এই অভিযোগের মধ্যে গত ১০ বছরে তারা মাত্র ৩৩৭টি অভিযোগ নথিভুক্ত করেছে। নিবন্ধিত মামলার মধ্যে ১৯৯টি মামলা যথাযথ নিষ্পত্তি ছাড়াই বন্ধ করে দিয়েছে তারা। তারা অন্যান্য সরকারী কর্তৃপক্ষের কাছে ১৯২টি মামলা বিচারের জন্য পাঠিয়েছে। এই পরিসংখ্যানই ভারতে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে NHRC-র গুরুত্বের উপর একটি বিশাল প্রশ্ন চিহ্ন তুলেছে। শুধু আমাদের কাজের ক্ষেত্রেই নয়, NHRC দেশের অন্যান্য বড় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রেও একই অবস্থানে কাজ করেছে, যেমন, মণিপুরে মানবাধিকার লঙ্ঘন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সহিংসতা, ৩৭০ অনুচ্ছেদের অগণতান্ত্রিক বাতিল এবং পরবর্তী সামরিক বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন, গত কয়েক বছরে কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘন, নব কলেবরে ফৌজদারী আইন আনা-র বিষয়েও NHRC চুপ করে সরকারকে সমর্থন জুগিয়েছে।
NHRC সম্পূর্ণরূপে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসাবে তার দায়িত্ব পরিত্যাগ করেছে যা রাষ্ট্র কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলবে। WBHRC সহ অন্যান্য প্রায় ১৭৫টি বিভিন্ন বিষয়ের মানবাধিকার কমিশনও এর থেকে আলাদা নয়। ১৯৯৩ সালে প্যারিস নীতি অনুসারে প্রত্যেক দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তদারকি করার জন্য নিজ নিজ দেশে মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটি সরকারী প্রভাব থেকে মুক্ত একটি সংস্থা হওয়া উচিত। কিন্তু, ভারতের NHRC সেই নীতিগুলিকে জানালার বাইরে ফেলে দিয়েছে। ভারতে বেশিরভাগ মানবাধিকার কমিশন বর্তমানে সরকারপন্থী ব্যক্তি-প্রধানদের দ্বারা চালানো হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে মানবাধিকার আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
রাষ্ট্র কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় নীরব দর্শকের অর্থ হল যে মানবাধিকার সুরক্ষা আইন, ১৯৯৩ এর অধীনে NHRC এর কার্যাবলী এ দেশে অচল করে দেওয়া। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলিতে NHRC অতীতে সুপ্রিম কোর্টের সামনেও হস্তক্ষেপ করে ছিল। তবে আজ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে কোনও ঘটনায়, NHRC সুপ্রিম কোর্টের সামনে বক্তব্য রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। NHRC আজ নীরব দর্শকের ভূমিকায় যা অনৈতিক এবং প্রকৃত অসাংবিধানিক।
আমরা উদ্বিগ্ন যে এই APF সম্মেলনের আয়োজক বিশ্ব মঞ্চে NHRC নিজের ভুলগুলিকে ঢেকে ফেলার আরো একটি সুযোগ পাবে। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে বিশ্ব দরবারের G-20 বক্তৃতায় ভারত কে 'গণতন্ত্রের জননী' বলার আগে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে ভারতীয় সংবিধান এবং ICCPR এবং ICESCR দ্বারা প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তার জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে NHRC একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে তার আদর্শগুলি যেন গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করে।"
প্রস্তাব পাঠের পর ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ দ্বারা গ্রামের মানুষের উপর অত্যাচার, মহিলা নির্যাতন, হত্যার ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ড এবং রাজ্য ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অকর্মণ্যতা এবং রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের নির্লজ্জ অমানবিক ভুমিকার উপর বক্তব্য রাখেন ৮জন ভুক্তভোগী পরিবারের মানুষ।
এছাড়াও বক্তব্য রাখেন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি শ্রী অশোক গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বলেন "মানবাধিকার লঙ্ঘনের অর্থ হচ্ছে দেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার হরণ করা। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার তা প্রতিদিন করে চলেছে, এর প্রতিকারে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।"
অল ইন্ডিয়া লইয়ার্স এ্যাসোসিয়েশন ফর জাস্টিস (আইলাজ) এর রাজ্য কনভেনর দিবাকর ভট্টাচার্য্য বলেন "সীমান্ত এলাকায় একটা অসম লড়াই চলছে। অসহায় গরীর মানুষের পাশে রাজ্য বা কেন্দ্র মানবাধিকার কমিশনগুলি দাঁড়াচ্ছে না। মানবাধিকার কমিশনগুলিকে কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দল কুক্ষিগত করে ফেলেছে। যদিও বা কোন ক্ষেত্রে মানবাধিকার কমিশন বিএসএফ এর বিরুদ্ধে কোন সুপারিশ দেয় তা কার্যকরী করতে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারগুলি নিস্ক্রিয় অবস্থান নিচ্ছে। এর বিরুদ্ধে সীমান্ত এলাকার মানুষদের সংগঠিত করে রাজ্য ভিত্তিক আলোড়নমুখি আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরী।"
পিইউসিএল এর পক্ষে অম্লান ভট্টাচার্য বলেন "আমরাও বহু অভিযোগ জানিয়েছি কিন্তু মানবাধিকার কমিশনগুলি এবং সরকার কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। তাই মানুষকে সচেতন করে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলতেই হবে।"
প্রত্যেক বক্তাই পুলিশ প্রশাসন ও রাজ্য বা কেন্দ্রীয় মানবাধিকার কমিশনের উপর নির্ভর না করে সীমান্ত এলাকার মানুষদের সংগঠিত করে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার উপর বক্তব্যকে কেন্দ্রীভূত করেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ডাঃ বিনায়ক সেন, বিশিষ্ট সমাজকর্মী অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরী, শ্রমজীবী মহিলা ও স্কীম কর্মী ঐক্য মঞ্চের শীলা দে সরকার সহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সংগঠন।
সভা শেষে মিছিল করে গান্ধী মূর্তির পাদদেশে জমায়েত হয়ে সংক্ষিপ্ত সভা হয়। সেই সভায় বক্তব্য রাখেন অবস্থানরত প্যানেল ভুক্ত শিক্ষক প্রার্থীদের মধ্যে একজন প্রার্থী রাজশ্রী দাস, কিরিটি রায়, অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরী প্রমুখ।
Edited By
Swarnali Goswami
Comments