স্বর্ণালী গোস্বামী
রাজ্যের মানুষকে কথায় কথায় পুলিশ- প্রশাসনের মত নিজেদের চাকর ভাবতে শুরু করেছেন? আপনাদের আস্পর্ধা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছেন না?
রাত ১০টা বেজে গেছে। শরীরটা ঠিক নেই। গা- হাত- পায়ে ব্যাথা। মানে বেশ ব্যাথা। ওষুধ খেয়ে রয়েছি। দুদিন ঘুরে এলাম রাঁচি থেকে। মন কিছুটা অক্সিজেন পেল, তাই শরীরকে তখন বলেছি, তোমায় পরে বুঝে নেব, আপাতত মনের কথা শুনি। এই সপ্তাহে প্রচুর কাজ ছিল দম বন্ধ করে একটার পর একটা গুছিয়ে সেরেছি। তার আগে গত সপ্তাহ থেকেই মন উচাটন হয়ে রয়েছে শহরের ঘটনায়। প্রতি মুহূর্তে অভিঘাত পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। বোকা বানানো হচ্ছে আমাদের সাধারণ মানুষদের। রাজনীতি, রাজ্যে খেলা চালাচ্ছে নিজের মত করে। তাতে একটা নাটুকে প্রলেপ দিয়ে দৃশ্য বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
বিষয়গুলো হজম করতে আজকাল শিখে গিয়েছি। মরে যেতে ইচ্ছে করেনা আর। উল্টে মন বলে, হাতে সেই ক্ষমতা থাকলে আর জি করের প্রিন্সিপালকে মুখে ঘুঁষি মেরে মেরে যদি থেঁতলে দিতে পারতাম, শান্তি পেতাম বড়। যে মুখ দিয়ে নিজের সাফাই গাইছে লোকটা, যে মুখে বলেছে, মেয়েটির রাতে সেমিনার হলে এক ঘুমোনো উচিত হয়নি, সেই মুখটাকেই থেঁতলে দিয়ে সারা গায়ে লোহার রডের বাড়ি মেরে মেরে হাত- পা ভেঙে দিয়ে মেরে ফেলতে পারলে শান্তি পেতাম। তাই মন অশান্ত হয়ে রয়েছিল গোটা সপ্তাহটাই।
জুলাই মাসের শুরুতেই টিকিট কাটা ছিল। ঘুরতে সবার মতই আমিও ভালোবাসি। আজকাল গুগল এবং ইউটিউব ট্রাভেল ব্লগারদের কল্যানে ঘুরতে যাওয়ার আগে সেই জায়গা সম্বন্ধে কিছু পড়াশোনা করে, কোন কোন পয়েন্টে ঘুরব তার একটা নিজের মত লিস্ট নোট ডাউন করে রাখি, পরে সেই বিষয়ে পড়াশুনো করে জেনে নিই। জানার বিষয়টা রেখে দিয়েছিলাম চলতি সপ্তাহের জন্য। কিন্তু গোটা সপ্তাহে এতটুকু অবকাশ পাইনি সেই কাজ সামলানোর। ঘরের কাজের পাশাপাশি নিজস্ব খবরের কাজ, রাজ্যের পরিস্থিতি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকা, সেই সম্বন্ধে সমানে আপডেট নেওয়া এই করতে করতেই দিন কেটেছে। যাওয়ার আগের দিন রাত দখলের মিছিলে সামিল হয়েছি মেয়েকে সঙ্গী করে। আলাদা করে সকলের সঙ্গে গলা মেলাইনি, চিৎকার করলে গলা ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা করে, কিন্তু টানা দেড় ঘন্টা বেহালা সখের বাজারের মিছিলে পা মিলিয়েছি সকলের সঙ্গে, দিনে এতটুকু বিশ্রাম না নিয়ে। বাড়ি ফিরে খবরের আপডেট আপলোড করে শুতে শুতে রাত ২.০০ টো। ভোরে ৪.০০ টের সময় উঠে ট্রেন ধরতে যাওয়া। তবে রাঁচি যাওয়ার যাত্রাপথ মনকে প্রলেপ দিতে শুরু করেছিল। তার মধ্যেও প্রতি মুহূর্তে রাজ্যের পরিস্থিতি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকছিলাম নিজের তাগিদ থেকেই। কাজেই শরীরের আর কী দোষ? বয়স হচ্ছে, আর এটুকু সে জানান দেবেনা তা তো হয়না?
১৪ তারিখ রাতে ওই ভিড় আমায় বিহ্বল করে তুলেছিল। রিম ও সারাদিন ব্যস্ত ছিল, কিন্তু তার মধ্যেও যাওয়ার আগে দেখলাম চট করে একটা পোস্টার লিখে নিয়ে নিয়েছে। মিছিলে ওর ছবি তুলতেই দিচ্ছিল না। আমার মন আত্মবিশ্বাসে ভরপুর ছিল নিজের মেয়েকে নিয়ে ছবি তো তুলতেই হত। ওর মনেও যথেষ্ট দাগ কেটেছে ঘটনাটা তা বলাই বাহুল্য। তাই আমি এই ব্যাপারে বেশ খুশি ছিলাম। আমি ব্যাপারগুলো নিয়ে আমার স্বামীর সঙ্গে ঠিক কথা বলতে পারিনা। প্রতিবাদ ওর ধাতে নেই। ঝগড়া আর প্রতিবাদ বিষয় দুটো আলাদা। তাই আমার মেলেনা। কিন্তু মেয়ের সঙ্গে মনের মিল পাই। মনে হয় এতেই সার্থকতা।
আবার ফিরি মূল কথায়। ১৫ তারিখ ভোরে বিভিন্ন পোর্টালে খবর দেখলাম আর জি কর হাসপাতালে তান্ডব চলেছে। আইএমএ ২৪ ঘন্টার বনধের ডাক দিয়েছে। শুনলাম হাসপাতালে পুলিশের ভূমিকা ছিল দর্শকের। পড়লাম মমতা তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে মিছিল করছে। তবে মেয়েদের রাত দখলের ডাক রাজ্য ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যেভাবে সাড়া ফেলেছে, তাতে গর্বে বুক ফুলে ওঠারই কথা। পাশাপাশি প্রান্তিক পুরুলিয়ার গ্রামের গুটিকতক মেয়ে মিলেও এই রাতে 'বিচার চাই' আওয়াজ তুলে নিজেদের জায়গাকে মুখরিত করে তুলেছিল, যা শিহরিত করে।
ক্রমে ক্রমে প্রকাশ পাচ্ছে আর জি করের ভেতরের স্ক্যান্ডাল। টাকার বিনিময়ে পাশ করিয়ে দেওয়া, ভালো পরীক্ষার্থী হলেও মূল দলে না ভিড়লে ফেল করিয়ে দেওয়া, সেক্স কারবার, ড্রাগ কারবার, সেই সমস্ত টাকা পার্টির ফান্ডে যাওয়া, নিহত চিকিৎসকের মা- বাবার বয়ান - সব সব কিছু। চিকিৎসক তো মারা গেছে ভোরে, বাড়িতে খবর দেওয়া হল বেলা ১০টার পরে কেন? মেয়ে আত্মহত্যা করেছে বলা হল কেন? হাসপাতালে মা- বাবা এলে মেয়ের কাছে নিয়ে না গিয়ে কিছু অপরিচিত ওষুধ দেখানো হল কেন, মেয়ে খেত বলে? যারা এই সমস্ত কাজ কর্ম করেছে, তারা দোষী নয়? তাদের শাস্তি প্রাপ্য নয়? যারা এই সমস্ত নির্দেশ দিয়েছে, তারা দোষী নয়? তারা ধর্ষক নয়? রাজ্য ক্রমাগত হাসপাতালের প্রিন্সিপালকে আড়াল করার চেষ্টা করছে কেন? কী স্বার্থ? পাশাপাশি চিকিৎসক শান্তনু সেনকে বিভিন্ন পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল কেন? মুখ্যমন্ত্রী লোক দেখানো মিছিল করছেন? কেন? রাজ্যের লোকজন চোখে ঠুলি পড়ে রয়েছে? তারা বুঝতে পারছেনা? কেন স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন, প্রতিবাদকে রাম- বাম কারসাজি বলা হচ্ছে? লোকজন নিজের বিবেকের দংশন শুনবেনা? তৃণমূল একাই ধোওয়া তুলসীপাতা? গতকাল নবান্নে কিছু নির্দেশিকা জারি হয়েছে, তাতে মহিলাদের রাতের ডিউটি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, কেন? পৃথিবী শুদ্ধ জনগণ চাইছে মেয়েদের রাত সুরক্ষিত করা হোক, রাজ্য সরকার মেয়েদের ঘরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে কেন? ক্ষমতা থাকলে পুরুষদের রাত ৯.০০ টার পর বাড়ি ঢুকে যেতে বলুন। এটা এই প্রজন্মের এক মেয়ের দাবি। আমার মেয়ে শুনেই এই কথাটা বলল। মেয়েরা সব কাজ সামলে নিতে পারবে। পুরুষদের রাতে বেরোনো বন্ধ করা হোক- এটাই ওর দাবি। শুনবেন রাজ্যের শাসক? শুনবেন তৃণমূলের মেরুদন্ডহীন প্রশাসকের দল?
সামনে পুজো। তৃণমূলের লোকজনদের উল্লাস করতে এতটুকু বাধবেনা? আরে রাজ্যের মানুষ ভালো নেই। আপনারা জোর করে মনেরও দখল নেবেন? লজ্জা করছেনা? পুজোর ক্লাব চাঁদা না নিয়ে মেয়ের বিচার চাইছেন। এর মধ্যেও আপনাদের হুকুম জারি করতে হবে, কুনাল ঘোষ? আপনি না সাংবাদিক? আপনি এভাবে হুমকি দেবেন তাই বলে? আপনাদের অনুদান প্রান্তিক মানুষের জন্যও যদি হয়, তবুও তাদের কাছে গিয়ে খোঁজ নিয়েছেন তারাও এ বছর পুজোয় আনন্দ করতে চায় নাকি? ক্লাবকে অনুদান না দিয়ে তাদের সরাসরি গিয়ে অনুদান দিন দম থাকলে। যে ক্লাব যেখান থেকে কাজ করে লোক দিয়ে তার খোঁজ নিয়ে তাদের সরাসরি সাহায্য করুন। ক্লাবগুলো যারা যারা অনুদান নিতে চাইছেনা, তাদের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিন। দম থাকলে। হুকুমজারি হচ্ছে? জুনিয়ার ডাক্তারদের প্রতিবাদের গলা বন্ধ করার হুকুম জারি হচ্ছে। কেন? কী পেয়েছেন আপনারা, রাজ্যের মানুষকে কথায় কথায় পুলিশ- প্রশাসনের মত নিজেদের চাকর ভাবতে শুরু করেছেন? আপনাদের আস্পর্ধা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছেন না?
ডার্বি বন্ধ করে দিলেন? কেন? আজ খেলার সমর্থকেরা পথে নামলো প্রতিবাদ জানাতে তাদের পুলিশ দিয়ে পেটালেন? লজ্জা হলনা? দেখলেন না, দেশ ভুলে জার্সি ভুলে সবুজ- মেরুন এবং লাল- হলুদ কিভাবে মিশে গেছে আপনাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে? লজ্জা করছেনা, প্রত্যেকটা আন্দোলনকে লাঠির ভয় দেখিয়ে বন্ধ করতে? লাঠিপেটা করতে শিখলে মানুষের কন্ঠকেও সমান গুরুত্ব দিতে হয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জানেন না? এই একই ব্যাপার বিজেপি শাসিত কোনও রাজ্যে হলে আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী গলা ফাটাতেন না? কী বলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? নিজের রাজ্যে, নিজের শাসনে সাত খুন মাফ না কি? একবার মনে হলনা, আমিই স্বাস্থ্য মন্ত্রী, আমিই পুলিশ মন্ত্রী, আমিই মুখ্যমন্ত্রী, এই অন্যায়ের দায় মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করি? নিহত চিকিৎসকের মা- বাবাকে ক্ষতিপূরণ দিতে গেলেন আপনি। একটু প্ল্যানে মিললনা। এই অভিভাবক আর পাঁচটা অভিভাবকের মত বিক্রি হলেন না, টাকার বিনিময়ে। টনক নড়ল আপনার, মুখ্যমন্ত্রী? কবে টনক নড়বে???