top of page

নভেম্বর নামচা

স্বর্ণালী গোস্বামী

উৎসব, সঙ্গী থাকে কিছু ভাবনাও

লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, দীপাবলি, ভাইফোঁটা হয়ে নভেম্বর প্রায় শেষ হতে চলল। পুজোর মরশুম আপাতত শেষ। এবারে সামনে আসছে শীতকালীন উৎসবের মরশুম। আসছে ক্রিসমাস, নিউ ইয়ার। কলকাতায় এই সময় বিভিন্ন জায়গা সেজে ওঠে। বিভিন্ন মেলা বসে। হস্তশিল্প মেলা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। তারপর ট্রেড ফেয়ার হবে, তার পেছেনেই আসবে বইমেলা। কিন্তু এসবের আগে অবশ্যই শহর মেতে উঠবে সিনেমা জ্বরে। এই ফিল্মোৎসবও কিন্তু শহরকে মাতিয়ে রাখে। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে আজকাল ছবি দেখানো হয় বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে।

যদিও বর্তমানে এই উৎসব নিয়ে প্রচুর কথাও হচ্ছে। আগের সেই মহিমা আর নেই চলচ্চিত্র উৎসবের। হয়ত বেশ খানিকটা ঠিকও বটে। কিন্তু এই যে সিনেমার মত একটা ব্যাপার নিয়ে গোটা শহর সেজে ওঠা সেটাও কি উপভোগ্য নয়? অন্য অর্থে দেখতে গেলে তাও একপ্রকার পাওনা বটে। গোটা একটা সপ্তাহ ছবির প্রতি নিবেদিত মানুষজন। তবে আমিও অবশ্যই বিশ্বাস করি, যেভাবে অতি সাধারনের নাগালের মধ্যে চলে এসেছে এই উৎসব, তাতে করে প্রকৃত সিনেমাপ্রেমীদের হলে বসে উৎকৃষ্ট মানের ছবি দেখতে একটু বিরক্তি আসে বৈকি। আলটপকা মন্তব্য, অহেতুক চটুল আচরণ যেন উৎসবের গরিমা কোথাও একটু ক্ষুন্ন করে। তার জন্য দর্শকদের আরও তৈরী হতে হবে বলে আমার মনে হয়। একটু বাজারি ব্যাপার এসে গেছে এই কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের মধ্যে।

আজকের লেখায় আরও একটা ব্যাপার উল্লেখ করতে হবে। তা হল, আগের দিন লেখা শেষ করেছিলাম ভারতীয় ক্রিকেট টিমের খেলা নিয়ে। সদর্থক নোট দিয়ে শেষ হয়েছিল আমার লেখা। ইতিমধ্যেই ফাইনাল হয়ে গেছে। গত সপ্তাহেই ছিল ফাইনাল। সবাই মিলে বসে খেলা দেখলাম। ভারত শুরু থেকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে জিতে এসে ফাইনালে পৌঁছেছিল। এই একটাও ম্যাচ না হারা, আমার কাছে বরাবর একটা খচখচানির কারন ছিল। নক আউট খেলায় না হেরে যায়। সেমিফাইনালে তবু নিউজিল্যান্ড ছিল বিপক্ষ টিম হিসেবে। জানতাম জান লড়িয়ে দিয়ে জিতবে। হয়েছিলোও তাই। প্রায় ৪০০ (৩৯৭) রান তুলেছিল ভারত। অসাধারন খেলা হয়েছিল সেদিন। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেও টসে জিতলে কি হত বলা যায়না। রোহিত শর্মাও হয়ত ফিল্ডিং-এর অপশনই নিতেন পিচের অবস্থা বুঝে, যা অস্ট্রেলিয়া করেছিল। তবে অস্ট্রেলিয়া সেদিন অসাধারন ফিল্ডিং করেছিল যা স্বীকার না করলেই নয়। রোহিত শর্মার ক্যাচ খেলার ফলাফল মোটামুটি বুঝিয়ে দিয়েছিল, তবু শেষ অব্দি লড়েছিল ভারত। দিনটা সেদিন আমাদের হয়ত ছিলনা।

কিন্তু একটা ব্যাপার যা না বললেই নয়, এই ফাইনাল নিয়ে মাতামাতি একটু বেশিই হয়েছিল আমাদের দেশে। সক্কলে যেন ধরেই নিয়েছিল, সময়ের অপেক্ষা, আমাদের হাতেই আসছে বিশ্বকাপ। বিসিসিআই- এর তরফে যেন একটু হামবড়া ভাবটা বেশিই চোখে লাগছিল। ইডেন বা ওয়াংখেড়েতে না করে নতুন স্টেডিয়ামে ফাইনাল খেলার ব্যবস্থা করল। নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামটি অবশ্যই অতি উচ্চ মানের স্টেডিয়াম, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেখানকার দর্শকরা? দেশকে, দেশের খেলোয়াড়দের কঠিন সময়ে কিভাবে উদ্বুদ্ধ করতে হয়, সেটাই জানেনা। তাছাড়া সৌরভ গাঙ্গুলিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল একেবারে ফাইনাল খেলার আগের দিন বিকেলে, তাও বাংলার মিডিয়া প্রচার করছিল, মহারাজ আমন্ত্রণ পাননি, সেই খবর রটার পর। ভারতের দুই বিশ্বকাপ বিজেতা ক্যাপ্টেন কপিল দেব এবং মহেন্দ্র সিং ধোনিকেও নাকি পার্সোনালি ইনভাইট করা হয়নি ২০২৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা দেখার জন্য। এমনটাই চারদিকে খবর। তবে খেলা শুরুর আগে যে লেজার শো- র আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানে বিগত বিশ্বকাপ জয়ী ক্যাপ্টেনদের সম্মান জ্ঞাপন করা হয়েছিল, এটাও ঠিক। তো, এমন সব ব্যাপার একটু দৃষ্টিকটু ছিল এবারে। প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার আগে বলে যাই, বিশ্বকাপের অব্যবহিত পরেই অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে টি- টোয়েন্টি ম্যাচে ভারত কিন্তু এক্কেবারে বদলা নিয়ে নিয়েছে, অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে।

এই মুহূর্তে সকলের মন পড়ে রয়েছে উত্তরকাশীর দিকে। উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারা থেকে দন্দলগাঁও তে একটি সুড়ঙ্গ তৈরি করার সময় শনিবার (১১ নভেম্বর) সন্ধ্যায়, সুড়ঙ্গটির শুরুর মুখ থেকে ২০০ মিটার দূরের একটা অংশ ধসে যায়। তাতে আটকে পড়েন ৪১ জন শ্রমিক। রবিবার থেকেই রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী এবং পুলিশের উদ্ধারকারী দল আটকে পড়া কর্মীদের উদ্ধারের চেষ্টা করেছে। পৌঁছেছে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। উদ্ধারকার্যের গতি বাড়াতে ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন সেচ দপ্তরের আধিকারিকরাও। কিন্তু কিছুতেই কিছু করা যাচ্ছে না। সুড়ঙ্গটি সাড়ে আট মিটার উঁচু এবং প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার দীর্ঘ। ভাঙা সুড়ঙ্গের ভিতরেই প্রায় ৬০০ মিটার ধ্বংসস্তূপের পিছনে আটকে পড়েছেন শ্রমিকেরা। উদ্ধারকারীরা পদে পদে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। আজ ১৪ দিন পরেও কোনও সুরাহা হলনা। উদ্ধারকারী দলে ধীরে ধীরে যোগ দিয়েছেন ইন্দো- টিবেটিয়ান পুলিশ, বর্ডার রোডওয়েজ বাহিনী। ভারতীয় বিমান বাহিনীর সি-১৭ পণ্যবাহী বিমানকে কাজে লাগানো হচ্ছে। সুড়ঙ্গপথে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন, খাবার দাবার ওষুধপত্র সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করা হচ্ছে। যোগাযোগ রাখা হচ্ছে আটকে পড়া শ্রমিকদের সাথে। তাদের দেওয়া হয়েছে মোবাইল ফোন, যাতে গেম খেলতে পারেন। দেওয়া হয়েছে লুডো বোর্ড। এইভাবে যাতে মন একটু ভালো থাকে তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। উত্তরকাশীতে টানেল বিপর্যয়ে উদ্ধারকারী টিমের অন্য়তম উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন ইন্টারন্য়াশানাল টানেলিং অ্য়ান্ড আন্ডাগ্রাউন্ড স্পেস অ্য়াসোসিয়েশনের সভাপতি প্রফেসর আর্নল্ড ডিক্স। স্পটে থেকে কাজ করছেন তিনি।

বৃহস্পতিবারের (২৩ নভেম্বর) মধ্যেই উত্তরকাশীর টানেল বিপর্যয়ে উদ্ধারকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। শ্রমিকদের বের করে আনার জন্য ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে যে ইভাকুয়েশন পাইপ ঢোকানো হচ্ছিল কমে আসছিল তার দূরত্বও। সুড়ঙ্গের বাইরে অপেক্ষায় ছিল অ্যাম্বুলেন্স, অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প। কিন্তু যে যন্ত্র দিয়ে সুড়ঙ্গের মাটি কাটা হচ্ছিল তাতে ফের প্রযুক্তিগত সমস্যা দেখা দেয়। যে কাঠামোর উপর দাঁড় করিয়ে যন্ত্রটিকে চালানো হচ্ছিল তাতেও ফাটল দেখা দেয়। শুক্রবার রাতে খননের সময় ভেঙে যায় অগার মেশিনের ব্লেড। শনিবার আধবেলা কেটে যায় কেবল ওই ভাঙা ব্লেড সুড়ঙ্গ থেকে বের করতেই। অগার মেশিন একেবারে নিস্ফল হয়ে যায়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ম্যানুয়ালি ড্রিলিং করিয়ে, অর্থাৎ শ্রমিকদের দিয়ে পাথর খনন করিয়ে উদ্ধারকাজ করতে হবে। অথবা উপর থেকে ৮৬ মিটার গভীর মাটি খনন। সেক্ষেত্রে কমপক্ষে আরও কয়েক সপ্তাহ সময় লেগে যেতে পারে শ্রমিকদের উদ্ধার করতে। এদিকে নতুন বাধা হল আবহাওয়া। ওই অঞ্চলে টানা তিনদিন বৃষ্টি ও তুষারপাতের পূর্বাভাস শোনাল আবহাওয়া দফতর। ওই এলাকায় হলুদ সতর্কতা জারি হয়েছে। উত্তরকাশী, চামোলি, রুদ্রপ্রয়াগ এবং পিথোরাগড়ে প্রবল বৃষ্টি ও তুষারপাত হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে যত অত্যাধুনিক মেশিনই আসুক না কেন, উদ্ধারকাজে বড়সড় বিপত্তি আসতে পারে।

তবে ১৬ দিনের মাথায় খুশির খবর একটাই, সুড়ঙ্গের মাথার উপর থেকে ড্রিলিংয়ের কাজ রবিবার দুপুরের পর থেকে শুরু হয়েছে। এদিনই হায়দরাবাদ থেকে প্লাজমা কাটার আকাশপথে নিয়ে আসা হয়েছে। এটা দিয়ে ভিতরে ভেঙে পড়ে থাকা অগার মেশিনের টুকরো এবং লোহার রডের বাধা কাটা যাবে। আজ ভারতীয় সেনা পৌঁছল উত্তরকাশীতে। তাঁরাই ম্যানুয়াল ড্রিলিং করে শ্রমিকদের বের করে আনবেন। এখন প্রতীক্ষা কবে আটকে পড়া ওই শ্রমিকেরা সুস্থভাবে যার যার বাড়ি ফিরে যাবেন এবং তাঁদের স্বজনেরা উৎকন্ঠা থেকে মুক্তি পাবেন।

যেতে যেতে আরও একটা নামচা বলে যাই। বেনারসের ধাঁচে আমাদের শহরেও এবার থেকে শুরু হল দেব দীপাবলি উৎসব। আজ ২৬ নভেম্বর এবং আগামীকাল ২৭ নভেম্বর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রচুর প্রদীপ জ্বালিয়ে গঙ্গার ঘাটকে আলোকময় করে তুলে, গঙ্গা আরতির মাধ্যমে বাবুঘাটে উদযাপন করা হচ্ছে এই দেব দীপাবলি উৎসব। এই দিনটি পালনের জন্য দীপাবলি উৎসবের পর এই কার্তিক পূর্ণিমায় বারাণসী, কাশীর ঘাটগুলি অজস্র প্রদীপে আলোকিত করা হয়। এবার মহানগরেও দেখা মিলবে সেই আলোর উৎসবের দৃশ্য।

bottom of page